বিজয়ের এইদিনে
ঢাকার আকাশ শত্রুমুক্ত, জাতিসংঘ উত্তপ্ত
৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত প্রসঙ্গে ফের অধিবেশন বসে।
তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব উত্থাপন করে। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে এবং পাক বাহিনীর সহিংসতার কারণে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে তাও অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন।
একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। আর চীন প্রস্তাটির বিপক্ষে ভোট দেয়। অন্য সদস্য দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
ওই দিন আরো আটটি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বারের মতো ভেটো দেয় (প্রথমটি দিয়েছিল ৪ ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের বিপক্ষে)।
একই সময়ে সোভিয়েত সরকার বার্তা সংস্থা ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে ‘পূর্ব পাকিস্তানেরর জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানায়।
এই দিন জাতিসংঘে সোভিয়েতের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে চীনের প্রতিনিধি বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউএন লাই ভারতীয় হামলার জবাবে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার কথা বলেন।
সবকিছু মিলিয়ে চিন্তিত করে তোলে বাংলার প্রবাসী সরকারকে। কারণ এদিনও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি (দিয়েছিল ৬ ডিসেম্বর)।
ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কেবি লাল ‘বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা বলে’ উল্লেখ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছিলেন।
এই দিন বকশীগঞ্জে যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্ত হয় পীরগঞ্জ, হাতীবান্ধা, বোদা, ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ। আর জীবননগর, দর্শনা ও কোটচাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে।
এ ছাড়া, দুইদিক থেকে মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদাররা।
এর আগে ৪ ডিসেম্বর বেনাপোল ও চৌগাছার বয়রা সীমান্ত দিয়ে হামলা শুরু করে মিত্রবাহিনী।
যশোর জেলা ছিল পাক হানাদারদের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। মুক্তিবাহিনীও কৌশলগত কারণে এ জেলাকে শত্রুমুক্ত করতে প্রাণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়।
ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে পাকসেনাদের সঙ্গে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয় চৌগাছা ও ঝিকরগাছার জগন্নাথপুর, গরীবপুর, আড়পাড়া, দিঘলসিংহা, ঢেঁকিপোতা, হুদোপাড়া, কদমতলা, মাশিলা, যাত্রাপুর ও সিংহঝুলি এলাকায়।
৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে এ যুদ্ধ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে জগন্নাথপুর আম বাগান এলাকায় দুই বাহিনীর রসদ ফুরিয়ে যায়।
তারপরও থেমে থাকেনি লড়াই। খালি হাতেই প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার বীর সন্তানরা। বন্দুকের বাট আর বেয়নেটের পাশাপাশি কিল, ঘুসি, লাথিই ছিল এই লড়াইয়ে শেষ সম্বল।
ভারতের ৫৭ মাউনটেন ডিভিশন আখাউড়ায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অবরোধ করে রাখে।
মিত্র বাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এখানে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী।
এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৬০ সদস্য নিহত হয়।
আর শহীদ হন লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি রুহুল আমিন, আমীর হোসেন, সাহাব উদ্দিন, মুস্তাফিজুর রহমানসহ অনেক মুক্তিপাগল বাঙালি।
আখাউড়া মুক্ত করতে মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এ যুদ্ধ হয়।
জয়ের পর যৌথবাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে সব বিদেশি জাহাজ চলে যাওয়ার অনুরোধ করে।
বিদেশি জাহাজগুলো এই সময় নিরাপত্তা চাইলে যৌথ কমান্ডার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে প্রতিপক্ষের ওপর তীব্র আক্রমণের ইঙ্গিত প্রদান করেন। এর ফলে পৃথিবীর সব দেশ বুঝতে পারে যে শিগগিরই বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে।
এই দিন লেফটেন্যান্ট আরেফিনের নেতৃতে নৌবন্দরে পরিচালিত হয় তীব্র আক্রমণ। এতে হানাদার বাহিনী বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো কোনো রকম বাধা ছাড়াই ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর একের পর এক হামলা চালাতে থাকে। তথ্য অনুযায়ী, এইদিন ভারতীয় বিমান বাহিনী ১২ ঘণ্টায় ২৩২ বার তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়।
এ ছাড়া ভারতীয় জঙ্গি বিমান থেকে বিভিন্ন স্থানে হানাদার কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৯০টি গাড়ি ধ্বংস করা হয়। পাশাপাশি ধ্বংস প্রাপ্ত হয় পাক সৈন্যবোঝাই অনেক লঞ্চ-স্টিমার।
বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ধ্বংস হয় পাকিস্তানের সাবমেরিন ‘গাজি’। যা তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল।
’৭১-এর এই দিন স্থলপথেও অনেকটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোতে থাকে মিত্র বাহিনী।
ভারতীয় বাহিনী প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়ে রণকৌশলের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান সড়গুলোতে অবরোধ সৃষ্টি করে।
বিচ্ছিন্ন করে দেয় যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এতে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও নাটোর এবং রংপুর ও যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এদিন সবচেয়ে বড় সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল কুমিল্লার লাকসাম এবং ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে।
এদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, ‘দেশ আক্রান্ত। ভারতীয়দের সহযোগিতায় কিছু বিশ্বাসঘাতক দেশ আক্রমণ করেছে। এ দেশের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করছে। তাদের সাহায্য করার জন্য প্রতিরক্ষা তহবিল করা হয়েছে।’ সে তহবিলে সাহায্য করার জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
তবে তার আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি।