বিজয়ের এই দিনে
চারদিক থেকে আসতে থাকে সাফল্যের গল্প
বাংলাদেশকে ভারত ও ভুটান কর্তৃক স্বীকৃতিদানের পর আজকের এই দিনে প্রবাসী সরকার উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকে শত্রুমুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু, খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
এদিন বিকেলে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে তিনি বলেন, জয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুদিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে, আরেক অংশ রয়েছে দক্ষিণে। দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা আক্রমণের গতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, পাকিস্তান বাহিনী যদি মাটি কামড়ে লড়াই করতে থাকে, তাহলে আপনারা কী করবেন? জবাবে তিনি বললেন, ‘তারা কী করবে জানি না। তবে আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত।’ সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা নদী। তবে সে বাধা অতিক্রম করার সব ব্যবস্থা হয়েছে। পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর আমাদের পিটি-৬৭ ট্যাঙ্কগুলো নিজেরাই নদী পেরোতে সক্ষম।’
অন্যদিকে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ‘ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তোমরা যদি বাঁচতে চাও, ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করো। নতুবা তোমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে।’ অবশ্য গত দিনগুলোর বক্তব্যেই তিনি আত্মসমর্পণের একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। হানাদারদের জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী আচরণ করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
থেমে থাকেনি পাক-মার্কিন বন্ধু চীনের কার্যক্রমও। চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি এক ভাষণে বলেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে। ভারত ‘তথাকথিত’ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তখন পর্যন্ত চীনের কাছে বাংলাদেশ ছিল ‘তথাকথিত’ বাংলাদেশ।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন করাচির কাছে অপেক্ষমাণ মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে যাত্রা করার নির্দেশ দেন।
পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণের ফলে আজকের এই দিনে ‘অবস্থা সংকটাপন্ন’বলে প্রথমবারের মতো মুখ খুললেন জেনারেল নিয়াজি। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রতিকূল অবস্থার কথা জানান।
নবনিযুক্ত (৬ ডিসেম্বর নিযুক্ত) প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন আজকের এই দিনে রেডিও পাকিস্তানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি তাঁর ভাষণে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতীয় বাহিনীর মোকাবিলা করার আহ্বান জানান। তিনি মিত্রবাহিনীর সমালোচনা করে বলেন, ‘তাদের হামলায় অসংখ্য বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।’
জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানি নেতা মাহমুদ আলী এদিন দেশে ফিরে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে সার্বিক অবস্থা বর্ণনা করেন।
সাংবাদিকদের কাছে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের উচিত বিশ্বশান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো। পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়ার জন্য তিনি চীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
আজকের এই দিনে যেসব অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো—দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা ও চট্টগ্রামের নাজিরহাট। দাউদকান্দি শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী থেকে ফলাও করে প্রচার হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের গল্প।