বিজয়ের এই দিনে
আত্মসমর্পণের ক্ষণগণনা শুরু
একাত্তরের এই দিনটি ছিল পাকবাহিনীর আত্মসর্পণের ক্ষণগণনার দিন। পাশাপাশি এটি ছিল একটি সরকার বিহীন দিন। কারণ ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হাউজে ভারতীয় বাহিনীর বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নিয়েছিলেন গভর্নর মালিক।
গত কয়েক দিন ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উড়তে শুরু করে। আর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত লক্ষ্য ঢাকায় সমবেত হওয়া।
এই দিনটিতে ঢাকাকে প্রায় সব দিক থেকে ঘিরে ফেলে যৌথ বাহিনী। তারা উত্তর, পূর্ব-উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক দিয়ে ঢাকার সন্নিকটে পৌঁছে যায়।
এদিকে নিয়াজিরা শুধু রাওয়ালপিন্ডির স্পষ্ট বার্তার অপেক্ষায় ছটফট করতে থাকে। বাংলাদেশ যে, আগামী প্রহরেই জন্ম নিচ্ছে তা কি আর তাদের বুঝতে বাকি ছিল? মোটেই নয়। তারা শুধু আনুষ্ঠানিক পরাজয়ের অপেক্ষা করছিল মাত্র। মনে মনে আরাধনা ছিল জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী নিরাপদে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া। আত্মসমর্পণের পর যেন তাদের হত্যা না করা হয়। এ ব্যাপারে নিয়াজি বিদেশি দূতাবাসগুলোর সঙ্গে একের পর এক যোগাযোগ করতে থাকেন। নিয়াজির এ বার্তা ঢাকার মার্কিন দূতাবাস পাঠিয়ে দেয় দিল্লির মার্কিন দূতাবাসে। সেখান থেকে তা পাঠানো হয় ওয়াশিংটনে। ওয়াশিংটন আবার পাঠায় ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসে। তাদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানের মতামত জানতে চায়।
তবে বিকেলেই পাকিস্তানের এ প্রস্তাব নাকোচ করেন জেনারেল মানেকশ। তিনি শর্তহীন আত্মসমর্পণের কথা বলেন। ভারতীয় বাহিনীর ধারণা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর এ আত্মসমর্পণের কথা ধাপ্পাবাজি হতে পারে। হয়তো এ কথা বলে তারা যুদ্ধবিরতির ফন্দি করতে চাচ্ছে। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানকে ভাবার জন্য একটু সময়ও দিয়েছিলেন। এ জন্য ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত বিমান হামলা বন্ধ রাখার কথা বলে। তবে অনেক জল্পনা-কল্পনা করে রাত ২টার মধ্যে সব বাহিনীকে আত্মসপর্ণের নির্দেশ দিয়েছিলেন নিয়াজি। কারণ তারা যদি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত না নিতেন তাহলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার পর থেকে বিমান হামলাসহ সর্বাত্মক হামলার হুমকি ছিল যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে।
এদিকে এসবের মধ্যেও হানাদার বাহিনীর মরণ কামড় অব্যাহত ছিল। গেল রাতেও (১৪ ডিসেম্বর) তারা জঘন্য এক মিশনে (বুদ্ধিজীবীদের হত্যা) সফল হয়েছিল। এ দিনও দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি ও যৌথবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়।
যখন পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ ভরসা সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে থেকেও আর এগোয়নি তখনই তাদের আশা স্তিমিত হয়। সপ্তম নৌবহর কেমন করে এগোবে? কারণ তাদের প্রতিহত করতেই ভারত সাগরে অবস্থান নেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের ২০টি জাহাজ। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করে ভারতীয় নৌবাহিনী। তাই বঙ্গোপসাগরে পৌঁছার ২৪ কিলোমিটার পথ মোটেও সহজ পথ ছিল না মার্কিন নৌবহরের জন্য।
আজকের এই দিনে শহীদ হন অকুতোভয় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। গৌড়ের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গনে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন সোনার দেশের এই সোনার ছেলেটি। যিনি দিনের বেলায় যুদ্ধ পরিকল্পনা করতেন আর রাতের বেলায় গেরিলা বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন হানাদারদের ওপর।
একাত্তরের এই দিনে মহানন্দা নদী পার হয়ে একের পর এক শত্রুঘাঁটি দখল করতে লাগলেন। তবে শত্রুর ছোড়া একটি বুলেট তাঁর কপালে বিধতে ভুল করেনি। লুটিয়ে পড়েন তিনি। দেহত্যাগ করে চলে যান লোক চক্ষুর অন্তরালে।
ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় সামরিক স্থাপনার ওপর আক্রমণ অব্যাহত থাকে ভারতীয় মিগ বিমানগুলোর।
আজকের এই দিনে চট্টগ্রামের ঘাঁটি ছেড়ে শহরের দিকে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। ফলে রাঙ্গুনিয়া শত্রুমুক্ত হয়। চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে উভয় পক্ষের মধ্যে রাতভর যুদ্ধ চলে।
এদিনটিতে পার্বতীপুর, নীলফামারী, বগুড়া, খাগড়াছড়ি, গোয়ালন্দ প্রভৃতি এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।
এ দিন দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় ছাপা হয়- ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীকে তাড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে। দেশের ভেতর বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত লোকজনও বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে।