ফিরে দেখা
সিরিয়া এবং সম্ভাব্য শান্তির সমীকরণ

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অফিশিয়াল ব্লগ DipNote. এই ব্লগে দপ্তরের মুখপাত্র জন কিবরী বিদায়ী বছরের একটি সাফল্য গাঁথা রচনা করেছেন। শুরুতেই এই মার্কিন সাফল্য ফর্দের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক, কিউবার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে আর্কটিক অঞ্চল এবং তার অধিবাসীদের রক্ষা করা, ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রকল্প নিশ্চিত করা, ইবোলা সংক্রমণের রাশ টেনে ধরা, জাতিসংঘের মাধ্যমে লাগসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ, ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টানারশিপ বা টিটিপি চুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি এবং সিরিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
‘সিরিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা’র স্বপক্ষে জন কিবরী ব্লগে যা বলেছেন তার সার সংক্ষেপ অনেকটা এ রকম : ‘সিরিয়ায় আসাদ সরকারের অত্যাচার-নিপীড়ন বিদায়ী বছরটিতেও নিত্য নতুন মাত্রা ছাড়িয়েছে। আসাদ সরকারের অমানবিক সন্ত্রাসের কারণে দেশটির লাখো মানুষ গৃহত্যাগী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমর্থিত আন্তর্জাতিক জোট সিরিয়ার মানুষের জন্য বছরজুড়ে সাহায্য সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রেখেছে। যা কি না ২০১১ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র করে আসছে। সেই সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির নেতৃত্বে দেশটির রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উদ্যোগ হিসেবে সিরিয়ার শান্তি রক্ষায় একটি রোডম্যাপ প্রণীত হয়েছে। যার আওতায় দেশটির মানুষ একজন নতুন নেতা নির্বাচিত করবে।’ মার্কিন দৃষ্টিতে মোটা দাগে এই হলো ‘সিরিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা’।
প্রতিদিন যে দর্শক টিভিতে সিরিয়ার রক্তাক্ত শিশুদের মুখোমুখি হন কিংবা রোজ সকালের খবরের কাগজে যাঁরা দুর্ভাগা এই দেশের এপিটাফ পাঠ করেন এবং সিরিয়ার সেসব মানুষ যাঁরা রোজ তাঁদের মূল্যবান জীবনের নির্মম অপচয় উপলব্ধি করছেন; স্বর্বস্ব হারাবার জ্বালায় জ্বলছে; তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র প্রণীত সিরিয়ার এই খতিয়ান বোধকরি এক নির্মম কৌতুক ছাড়া আর কিছু নয়।
কারণ তারা জানে বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালজুড়েও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সিরিয়া নিয়ে যা করেছে সেটা স্রেফ নির্জলা প্রতারণা-জালিয়াতি। সেই আরব বসন্তের শুরু থেকে সিরিয়ার সঙ্গে এটাই করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। আরব বসন্তের জের টানতে হলো এই কারণে যে; বাহরাইনের মানুষও গণতন্ত্র চেয়েছিল। দেশটির ক্ষমতাসীন একনায়ক বাদশা তখন পাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরেছিলেন। সরকারবিরোধীদের খতম করতে গুণ্ডা ভাড়া করবার মতো রীতিমতো সৌদি সেনাদের ভাড়া করে বাহরাইনের রাজপথে নামিয়েছিলেন। পশ্চিমা গণমাধ্যমে তখন বাহরাইন শব্দটাও উচ্চারিত হয়নি। কারণ দেশটা ইউরোপ-আমেরিকার বন্ধু। কেবল এই কারণে বাহরাইনকে সিরিয়ার পরিণতি বরণ করতে হয়নি। ১২, ১৩ আর ১৪ এর ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের পুরোটা বছর বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে হেন কোনো অকাজ নেই যা ওয়াশিংটন ও মিত্ররা করেনি।
আসাদের পতন তরান্বিত করতে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির জন্য আকাশ থেকে টনকে টন রসদফেলা হয়েছে সিরিয়ায় (যা আগের বছরও হয়েছে)। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো বছরজুড়ে সিরিয়ার রণাঙ্গনের কোথাও কথিত উদারপন্থী বিদ্রোহী কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় ‘ভালো সন্ত্রাসী’দের দেখা যায়নি। বরং তাদের জন্য দেওয়া সেসব মার্কিন রসদ দেখা গেছে আইএস, নুসরা ফ্রন্ট, জয়েশ আল ইসলাম, লিওয়া আল তৌহিদের মতো কট্টরপন্থী জঙ্গিদের হাতে। আর কে না জানে দিনশেষে এদের একটাই পরিচয়; আইএস। এমন অন্তত ১৬০ থেকে ১৭০টি সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে দেদার অস্ত্র গোলাবারুদ এমনকি টয়োটা পিকআপ ট্রাক পর্যন্ত প্যারাশ্যুট বেঁধে ফেলা হয়েছে সিরিয়ার মাটিতে। নতুন মডেলের চকচকে সেই টয়োটা পিকআপ কার নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমে শিরোনাম হলে উল্টো টয়োটা কোম্পানিকেই চিঠি লিখে জানতে চেয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। যেনবা যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং জাপানের টয়োটা কোম্পানিই জঙ্গিদের পিকআপ উপহার দিয়েছে।
বরাবরের মতো সিরিয়া প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের এমন দ্বিমুখী নীতির অন্ধ অনুকরণই করে গেছে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, তুরস্ক, জর্ডান আর ইসরাইলের মতো মার্কিন বন্ধুরা। আইএস বিরোধী লড়াইয়ের নাম করে এই দেশগুলো সিরিয়ার কথিত ‘ভালো সন্ত্রাসী’দের অর্থ অস্ত্র আর প্রশিক্ষণের মদদ দিয়ে গেছে। চোরাই পথে জঙ্গিদের পাচার করা তেল বাণিজ্যের ভাগিদার হয়েছে। আহত জঙ্গিদের তুরস্ক-ইসরাইলের সামরিক হাসপাতালে পরম মমতায় চিকিৎসাসেবা দিয়েছে এবং ওই সন্ত্রাসীদের মাসকাবারি বেতন দিয়ে পুষেছে।
একদিকে ভালো সন্ত্রাসী নামের মুখোশের আড়ালে আইএস জঙ্গিদের এমন বহুমুখী মদদ দেওয়া আবার তাদের বিরুদ্ধেই সিরিয়ার মাটিতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। বছরজুড়ে সিএনএন ফক্স নিউজসহ মার্কিন গণমাধ্যমে যতবার আইসিস বা আইসেল শব্দটা উচ্চারণের মধ্যদিয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোর বাণিজ্য হয়েছে; তার সিকিভাগ বোমাও যদি ঠিকঠাক ছোঁড়া হতো তাহলে তিনমাসেই আইএস জঙ্গিদের বংশ নির্বংশ হতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি। কারণ ইরাক-সিরিয়ার রাজনীতিতে আইএস তাদের সোনার ডিমপাড়া হাঁস। এত সহজে যে তারা এই হাঁস বিসর্জন দিচ্ছেন না এটা স্পষ্ট। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বধীন ৭০ দেশের জোটের আইএসবিরোধী লড়াই ছিল বছরের নিকৃষ্টতম প্রতারণা।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র বন্ধুদের এমনি ধারাবাহিক প্রতারণার ফলাফলই আজকের সিরিয়া। যেখানে অক্টোবর পর্যন্ত নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল আড়াই লাখ। যদিও প্রকৃত সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি বলে আশঙ্কা অনেক সংস্থার। আর গৃহত্যাগী মানুষ অন্তত এক কোটি দশ লাখ। কেবল ইউরোপেই পাড়ি জমিয়েছে অন্তত ১০ লাখ। সিরিয়ায় অমন নরকতুল্য পরিস্থিতি সৃষ্টির করে বিশ্বকে শতাব্দীর সবচেয়ে অমানবিক শরণার্থী সংকট উপহার দিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা। যা কি না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেও কয়েকগুণ বেশি। বছরজুড়ে গ্রিসের লেসবস মেসিডোনিয়া সার্বিয়া আর হাঙ্গেরির সীমান্তে রচিত হয়েছে অমানবিকতার কত না উদাহরণ। কাঁটাতারের বেড়া জন্ম দিয়েছে মর্মবেদনার কত না উপাখ্যান। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে গিয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কান্না ভুলেছে কতই না আইলান। সেই আইলান। তুরস্কে এজিয়ান সাগরের বালুকা বেলায় পড়েছিল যার নিষ্প্রাণ দেহ। ক্ষণিকের জন্য হলেও হয়তো আইলানের আয়নায় নিজেদের দেখেছিল ইউরোপ। ইউরোপের পত্রিকায় তাই শিরোনাম হয়েছে: ‘আইলানদের জন্য হৃদয় ও দুয়ার দুটোই খুলেছে ইউরোপ’। তারপরও মানবিকতার সব সীমা ছাড়িয়ে আইলানরা দলে দলে ভেসে বেড়িয়েছে ইতালির ল্যাম্পেদুসা থেকে ফ্রান্সের ক্যালে বন্দরে। একটু খানি আশ্রয়ের আশায়। দাঁড়াবার মাটি পাবার আশায়। তাদের যে মাতৃভূমির মাটি বিষাক্ত করে ছেড়েছেন পশ্চিমা নেতারা। যা তাঁরা করেছেন কেবল বাশার আল আসাদকে তাড়াতে। আসাদ স্বৈরাচার ক্ষমতালোভী নির্মম শাসক, তাঁর হাতে কোটি মানুষের রক্ত এবং তার চাইতেও তাঁর সবচেয়ে বড় দোষ তিনি ইউরোপ আমেরিকার অপছন্দের মানুষ। অথচ সেই আসাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সন্ত্রাসীরা। না তারা আইএসকে খতম করেছেন। না তারা আসাদকে সরিয়ে তাঁদের ভাষায় সিরিয়ার মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছেন।
সম্ভবত এমন একটা মোক্ষম ক্ষণের অপেক্ষাতেই ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অক্টোবরের শেষ সপ্তায় কাসপিয়ান সাগরের রণতরী থেকে এক হাজার ৫০০ মাইল দূরের সিরিয়ায় ক্রুজ মিসাইলের হামলা এবং জঙ্গি বিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়ে পশ্চিমা নেতাদের আদরের ভালো সন্ত্রাসীদের একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়ার মধ্য দিয়ে সিরিয়ার রণাঙ্গনে নাটকীয় আবির্ভাব ঘটালেন পুতিন। রাতারাতি পাল্টে গেলো রণাঙ্গনের ছক। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের যে জঙ্গি বিমানগুলো প্রায় তিন বছরের লড়াইয়েও আইএস জঙ্গিদের ক্যাম্প অস্ত্র গুদাম প্রশিক্ষণ শিবির কিংবা চোরাই তেলের ট্রাক বহরগুলো দেখতে পাচ্ছিল না; রুশ বোমায় রাতারাতি সেসব ধ্বংস হতে থাকল। মাত্র সাতদিনের বিমান হামলায় সিরিয়ার রণাঙ্গনে রীতিমতো ছত্রভঙ্গ অবস্থা দাঁড়াল আইএস জঙ্গিদের। আলেপ্পো পালমেইরা হামা হোমস আর দামেস্কের রণাঙ্গনে একে একে সাফল্য পেতে শুরু করে আসাদ অনুগত সেনারা। টান পড়তে শুরু করে জঙ্গিদের রসদে। সেই সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের সাথে তুরস্কের বন্ধুত্ব নিয়ে একের পর এক হাটে হাড়ি ভাঙতে শুরু করেন পুতিন। জঙ্গিদের সাথে গোপন তেল বাণিজ্য, তুরস্কের মাটিতে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবির এমনকি জঙ্গিদের হাতে রাসায়নিক অস্ত্রের চালান পৌঁছে দেওয়ার খবরগুলো যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়ার রাজনৈতিক মেরুকরণে নিত্য নতুন খোরাকের জন্ম দেয়। সবশেষ আসাদকে ক্ষমতায় মেনেই সিরিয়ায় সম্ভাব্য একটি শান্তির রোডম্যাপে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যাকে ভিত্তি ধরে জানুয়ারিতে জেনেভা শান্তি আলোচনা শুরুর কথা রয়েছে।
সম্ভাব্য এই আলোচনাই হতে পারে সিরিয়ায় শান্তির প্রথম পদক্ষেপ। তবে রাতারাতি সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশাও ক্ষীণ। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা এই আলোচনায় যোগ দেয় কি না তা নিয়েও সংশয় আছে। রুশ গণমাধ্যম আরটির অনুসন্ধান বলছে সিরিয়ার রণাঙ্গনে সক্রিয় এই বিদ্রোহীদের শতকরা ৬০ শতাংশই আসলে মুখোশ পরা আইএস। যুক্তরাষ্ট্রের চোখে যারা ‘ভালো সন্ত্রাসী’। শান্তি আলোচনার নামে এদের পুনর্বাসন করে মধ্যপ্রাচ্যকে আরো বছর দশেকের জন্য স্থায়ী জঙ্গি উৎপাদনের ঘাটিতে পরিণত করার মার্কিন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আসাদ-পুতিন ভালোই ওয়াকিবহাল। যা তাঁরা আফগানিস্তানে করেছেন। ইরাকে করেছেন। সবমিলিয়ে নতুন বছরেও সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কি না সেটা নির্ভর করছে দেশটিকে ঘিরে সৌদি-পশ্চিমা নেতারা তাঁদের পাপাচারের রাশ কতটা টেনে ধরলেন তার ওপর।
লেখক : সাংবাদিক। ৭১ টিভির জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক।