ভূমিকম্প
দুর্যোগ আসছে, আমরা প্রস্তুত তো?
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পাওয়া একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ভূমিকম্পের পর স্বামী স্ত্রীকে বলছে, ‘তুমি কি টের পেয়েছ যে ভূমিকম্প হচ্ছে?’ ‘তাই নাকি, আমি তো ভাবলাম তুমি পাশ ফিরছো, দিন দিন যা মোটা হচ্ছো!’ স্ত্রীর উত্তর। আরেকটি কৌতুক এমন, ‘ওপরের বাসায় নবদম্পতি ভাড়া নিয়েছে, তাই মনে হলো বিল্ডিং কাঁপছে!’। তো ভূমিকম্প শেষ হওয়ার পর এ নিয়ে কৌতুকের যেন শেষ নেই। কিন্তু ভূমিকম্প তো এখন আর কৌতুকের জিনিস নেই বাংলাদেশিদের কাছে। শীতের শান্ত ভোরে যখন কেঁপে উঠল সারা দেশ, আমি তখন অফিসে ব্রেকিং লিখছি ‘সারা দেশে ভূমিকম্প অনুভূত’। খুঁজছি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও জরিপ সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভেতে (ইউএসজিএস) এর মাত্রা ও উৎপত্তিস্থল। এটাই বাস্তবতা। সহকর্মীদের অনেকে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছেন। আমিও এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছি যেখানে ওপরে বিম বা পিলার রয়েছে। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ ভূমিকম্পের সময় প্রথম ঝাঁকুনিতে হুড়োহুড়ি বা দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। ঘরের মধ্যেই একটি নিরাপদ জায়গা বেছে নেওয়া উচিত।
এটা যে কতটা সত্য তার প্রমাণ মিলল ৪ জানুয়ারির অনলাইন ও টেলিভিশনের সংবাদে। সারা দেশে তিনজনের মৃত্যু ও শতাধিক লোক আহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। রাজধানীর পূর্ব জুরাইনে যিনি মারা গেছেন, তিনি নিচে নেমে এত আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। রাজশাহী ও লালমনিরহাটে যে দুজন মারা গেছেন তাঁরাও আতঙ্কে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় লোকজন আহত হয়েছেন হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা যে বলি ভূমিকম্পে মানুষ মারা যায় কথাটা ঠিক নয়, ভূমিকম্পে মানুষ মরে না! মরে ভবনধসে, আতঙ্কিত হয়ে নামতে গিয়ে। সোমবার ভোরের যে ভূমিকম্প তার উৎপত্তিস্থল ভারতের মনিপুরের ইম্ফল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে টামেংলং জেলার নোনি গ্রামে। এর মাত্রা ৬ দশমিক ৭। ঢাকার আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে উৎপত্তিস্থল ৩৫৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। রিখটার স্কেলে ঢাকায় কম্পনের তীব্রতা ছিল চারের বেশি। মাটির খুব বেশি গভীরে না হওয়ায় কম্পন বেশি অনুভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধরনের ভূমিকম্পকে ‘শ্যালো ফোকাস আর্থকোয়েক’ বলা হয়। এটিকে বলা হচ্ছে সশব্দ ভূমিকম্প।
ভূমিকম্পের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে এটি কোনো পূর্বাভাস দেয় না। এ ছাড়া মেইন শকের পর আরো কয়েকটি আফটার শক বা ফোর শক হতে পারে। সে কারণে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ভূমিকম্পে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রথম কাজ হলো, মেঝেতে শুয়ে পড়ে অথবা মাথা নিচু করে বালিশ বা নরম কিছু দিয়ে ঢেকে চেপে ধরা। মানে মাথা বাঁচানো। বহুতল ভবনে থাকলে কলাম বা বিমের কাছাকাছি অবস্থান করা। ভূমিকম্পের সময় বহুতল ভবন থেকে সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামা যাবে না। লিফট দিয়ে নামা যাবে না। খোলা মাঠে যেখানে আশপাশে কোনো গাছ বা ভবন নেই সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আসলে এই কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়া মাত্র। প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য এই বিষয়গুলো দেখানো হয়। রডের বিজ্ঞাপনে তো কোন রড ভালো প্রমাণ করতে ভূমিকম্প সহনীয় রডের কথা বলা হচ্ছে। এরপরও হয়তো বিপদগ্রস্ত মানুষ সেটা মনে রাখতে পারেন না।
তবে ভূমিকম্প ঘটার আগাম সংকেত পাওয়া না গেলেও পশুপাখি নাকি আগাম টের পায়। যদিও এটার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ১৯৭৫ সালে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর আগে হঠাৎ করে ইঁদুর, খরগোশ, সাপসহ গর্তে বাস বিভিন্ন প্রাণি বেরিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু সে সময় ছিল শীত, এদের গর্তে থাকার কথা। ১৯৬৪ সালে আলাস্কায় ভূমিকম্প ঘটার আগের দিন শীতনিন্দ্রা থেকে কোডিয়াক ভালুকগুলো বের হয়ে আসে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পের আগে নানা প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণের খবর পাওয়া গেছে।
এবার দেখা যাক, ভূতাত্ত্বিক কারণে বাংলাদেশে বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চল। সীমান্তবর্তী এবং ভেতরের ভূ-চ্যুতিগুলো এই চার অঞ্চলের সন্নিহিত। এ ছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় মাটি ভরাট করে যে ভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। এখন কথা হচ্ছে, বিকেলের সোনারোদ চুরি করা ইট কাঠ, পাথরের জঞ্জালের শহর ঢাকাকে আমরা বলে থাকি এটা ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ চলছে। কথাটা ক্ষোভ থেকে বললেও এটা ঠিক, কিছু একটা ঘটার পর আমরা সেটা নিয়ে মেতে উঠি, পরে আবার ভুলে যাই। এই যে ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ এটা নিয়ে কলাম লেখা হবে, টকশো হবে, সেমিনার হবে, কিন্তু এতে সমাধান কতটা হবে। আলোচনার পর বিশেষজ্ঞরা যে বিষয়গুলোর সমাধান করতে বলেছেন, তার কি কখনো সমাধান হয়েছে? ভূমিকম্প যেহেতু আগাম পূর্বাবাস দেয় না তাই কিছুটা সচেতনতা বাড়াতে নির্মাণ করতে হবে আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, একই সঙ্গে ভবনে ঢোকার গলি যাতে সরু না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা, বিভিন্ন এলাকায় যে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো চিহ্নিত করা জরুরি।
ভূমিকম্পের সময় ধর্মীয় উপাসনাগুলো থেকে ভেসে আসছিল প্রার্থনা। আজানের সুমধুর সুর, মন্দিরের শঙ্খ আকুল করে, নাচিয়ে দেয় ধমনি। আবার ফেসবুকে দেখলাম কেউ কেউ এককাঠি সরেস। থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন, আমাদের নৈতিক স্খলনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে। আসলে ভূমিকম্প নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে নানা ধরনের আচার চালু রয়েছে। খ্রিস্টান ও ইহুদিরা মনে করে, মন্দ লোকদের শাস্তি দিতে ঈশ্বর ভূমিকম্প ঘটান। গ্রিকদের বিশ্বাস, দেবরাজ জিউসের সঙ্গে এক যুদ্ধে হেরে যান অপর দেবতা অ্যাটলাস। জিউস তাঁকে সাজা হিসেবে পৃথিবী কাঁধে তুলে নিতে নির্দেশ দেন। সেই থেকে অ্যাটলাসের কাঁধে রয়েছে পৃথিবী। কাঁধ পরিবর্তনের সময় কেঁপে ওঠে পৃথিবী। চীনাদের মতে, তাদের শক্তিধর ড্রাগন মাটির অনেক গভীরে বাস করে। ড্রাগন কখনো বিরক্ত হলে নড়েচড়ে ওঠে। জাপানি পুরাণে আছে, বিশাল এক মাগুর মাছের পিঠে অবস্থান করছে পৃথিবী। মাছটি কখনো নড়ে উঠলে ভূমিকম্প হয়। আবার অনেক প্রাচীন শাস্ত্র মতে, কচ্ছপের পিঠে রয়েছে পৃথিবী, কেউবা বলেন, গরুর শিং এ ঝুঁলছে পৃথিবী।
ভূমিকম্প নিয়ে গল্প যাই থাক না কেনো, এই সমস্যা গুরুতর, ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের প্রস্তুতি যেন কচ্ছপ গতিতে না আগায়। কারণ এই যে ছোট ছোট কম্পন তা অনেক সময় বড় আঘাতের পূর্ব প্রস্তুতি বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন।