ভূমিকম্প
আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা
ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়তাম, জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ। সেখানে ঘনঘন ভূমিকম্পে পাকা ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ার কারণে কোনো বহুতল ভবন তৈরি করা হতো না। কাঠের তৈরি স্বল্পমেয়াদি বিশেষ ধরনের একপ্রকার বাড়িঘর তৈরি করা হতো। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ভেতরে আজ জাপান আর সে জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। ভূমিকম্পের আতঙ্ককে জয় করে জাপান এখন পৃথিবীর অন্যতম সম্পদশালী ও ধনী রাষ্ট্র। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্থাপত্য নকশাশৈলীর বহুতল ইমারত এখন জাপানের সৌন্দর্য বর্ধন করে চলেছে।
প্রাকৃতিকভাবে ভৌগোলিক অবস্থায় সাগর, দ্বীপ, পাহাড়-পর্বত, মালভূমি পরিবেষ্টিত সিসমোগ্রাফিক জোন বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে থাকে। ভূ-তাত্ত্বিক ভাষায় ভূ-গর্ভে পাশাপাশি থাকা দুটি টেকটোনিক প্লেটের ওলট-পালট স্থানচ্যুতির দরুন ভূ-পৃষ্ঠ কেঁপে উঠে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। সমতলভূমিতে এর প্রকোপ অপেক্ষাকৃত কম। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ কমবেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। সে কারণেই ভূ-তাত্ত্বিকদের ভবিষ্যৎবাণী কিংবা পূর্বাভাস মতে এ অঞ্চলের মানুষদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে বৈকি। কিছুদিন পরপর বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প এ আতঙ্ককে আরো এক ডিগ্রি করে বাড়িয়ে দিয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) বরাত দিয়ে কয়েকটি চ্যানেল এবার ভূমিকম্প হয়েছে ৬.৭ মাত্রার। সে ভূমকম্পের কেন্দ্রস্থল নাকি ছিল আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মনিপুরের রাজধানীতে। সেখানে আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট ইত্যাদি জায়গায় কমপক্ষে তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। আতঙ্কে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো কমপক্ষে শতাধিক। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে আতঙ্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ডাইনিংয়ের বাবুর্চির মতো অশিক্ষিত মানুষ যেমন আতঙ্কিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, ঠিক সে রকম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীরাও বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে হাত-পা ভেঙেছে। কাজেই এ বিষয়ে সবার জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ ও প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন।
কিছুদিন আগে অর্থাৎ গত ২৫ এপ্রিল’২০১৫-তে রিখটার স্কেলে ৭.৯ মাত্রার যে ভূমিকম্পটি নেপালে কেন্দ্রীভূতভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে শেষপর্যন্ত প্রায় দশ হাজার লোক মৃত্যুর মাধ্যমে এক মানবিক বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে আরো প্রায় ৫০ হাজার লোক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভেঙে পড়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভবন-ইমারত, ধ্বংস হয়েছে অনেক মূল্যবান রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সহায়-সম্পত্তি, থমকে গেছে জনজীবন। সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং যথাসাধ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভূমিকম্পের এ আঘাত ভারত, বাংলাদেশ ও চীনে স্বল্পমাত্রায় হলেও লেগেছিল। তবে এসব দেশ ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু না হওয়াতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি কম হয়েছে। আমার ধারণা, সেই ভূমিকম্পের কবলে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যত মানুষ আহত ও মৃত্যুবরণ করেছে; তার মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে গিয়ে। ২৫ এপ্রিলের বড় ভূমিকম্পের পর এ পর্যন্ত নেপালে আরো অনেকবার ভূমিকম্প হয়ে আতঙ্কের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশেও এরপর আরো চার-পাঁচবার হালকা মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে সব জায়গায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ বড় একটি ভূমিকম্পের পরে ‘আফটার এফেক্ট’ হিসেবে ছোট ছোট আরো কয়েকটি কম্পন অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া আমাদের এ অঞ্চল একটু বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ায় সব সময়ই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, হাট-বাজার, অফিস-আদালত, বাসা-বাড়িসহ সবখানে ভূমিকম্প আতঙ্ক এখন নিত্যদিনের সঙ্গী।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, আমাদের দেশ একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। আর এ ধরনের ছোটখাটো ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়। বিশেষজ্ঞ মতামতে এও বলা হচ্ছে যে, বড় ধরনের ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার সম্ভাবনা নাকি দেশের মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকাগুলো। ভূমিকম্প একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এ দুর্যোগটি অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে একটু ভিন্নতর। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বন্যা, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি সংঘটিত হওয়ার কিছু সময় আগে হলেও বুঝতে পারা যায়। কিন্তু ভূমিকম্প সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত বোঝার কোনো উপায় থাকে না। সে জন্য তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে এর কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ও প্রতিকার নেওয়ারও সুযোগ থাকে না বিধায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। বাংলাদেশের জন্য এটি অবশ্যই একটি মারাত্মক আতঙ্কের বিষয়। কারণ এখানে পূর্বপরিকল্পিত কোনো নগরায়ন করা হয়নি। হয়নি বিল্ডিং কোড মেনে কোনো বিল্ডিং। নেই কোনো পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা, নেই কোনো যন্ত্রপাতি, এমনকি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে গেলে দ্রুত উদ্ধারকার্য সম্পাদন করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই।
রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য সিসমোমিটার যন্ত্রটি পর্যন্তও আমাদের দেশে না থাকায় ইউএসজিএসের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও আমাদের নিজেদের বাঁচার স্বার্থে এর আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া থেকে নিয়মতান্ত্রিভাবেই বিরত থাকতে হবে : (১) ভূমিকম্পের অনুভূতি টের পেলে অযথা এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি না করে মাথায় যেকোনো একটা সাপোর্ট নিয়ে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এখানে নিরাপদ স্থান বলতে বিল্ডিংয়ের ভেতরে ফাঁকা জায়গায় না দাঁড়িয়ে কোনো বিমের নিচে কিংবা পিলারের সাপোর্ট নিয়ে দাঁড়াতে হবে। (২) পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা আছে এরূপ কোনো স্থান যেমন-টেবিলের নিচ, উঁচু খাট, চৌকি, সোফা ইত্যাদির তলায়/নিচে মাথায় একটু সাপোর্ট নিয়ে বসে বা শুয়ে পড়তে হবে। (৩) তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় একটি বালিশ/কোল-বালিশের সাপোর্ট নিয়ে যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে যেতে হবে। অন্যকিছু না পেলে যে যেখানে থাকবেন সেখানে মাথায় শুধু দুটি হাত দিয়ে ঢেকে রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। (৪) কিন্তু বহুতল ভবন থেকে কোনো অবস্থাতেই দৌড় দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ সাধারণত ভূমিকম্পের স্থায়িত্বকাল খুব বেশি সময়ের হয় না। সে জন্য দৌড় দিলে বরং আরো বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। (৫) যে কোনো বিপদে মানুষ বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক। অনেক সময় চেষ্টাটাই আরো বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (৬) তবে একবার ভূমিকম্প হওয়ার কিছুক্ষণ পরপর আবার কয়েকটি কম্পন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে জন্য একবার ভূমিকম্প হয়ে থেমে গেলে তখন বের হয়ে ঘণ্টাখানেক বিল্ডিংয়ের বাইরে অবস্থান করা। (৭) কাঁচা ঘরবাড়ি হলে বিপদের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম বিধায় এ ক্ষেত্রে ছোটাছুটি একেবারেই অহেতুক। (৮) ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার পর দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা শুরু করার জন্য ফায়ার সার্ভিসসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য সব সংস্থাকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রস্তুত থাকা দরকার। সে জন্য সেসব সংস্থাকে প্রযুক্তি ও কারিগরিভাবে দক্ষ ও সক্ষম করে তুলতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, বেসরকারি সংস্থাগুলো, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সচেতন মহল থেকে এসব বিষয় যত বেশি প্রচার করা যাবে তত বেশি সুফল পাওয়া যাবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।