জাগো বাহে
অভিভাবকহীন কুড়িগ্রাম!
বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। দেশের সবচেয়ে উন্নত জেলার সঙ্গে এ জেলার দারিদ্র্যের হার চরম বৈষম্যপূর্ণ। কুষ্টিয়া জেলার দারিদ্র্যের হার মাত্র চার শতাংশেরও কম আর কুড়িগ্রামে এই দারিদ্র্যের হার ৬৩. ৭ শতাংশ। এই বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়নচিত্র জানার পরও দারিদ্র্য ব্যবধান দূরীকরণে সরকারের কোনো চেষ্টাই নেই। কুড়িগ্রামের এই কলঙ্ক তিলক দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সব সময়েই সূচিত হয়ে আসছে। পিছিয়ে থাকা এ জেলার অবস্থার পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা কোনো সরকারই বিশেষভাবে গ্রহণ করেনি। ধারাবাহিক অনটন এক সময়ে দারিদ্র্যপীড়িত কুড়িগ্রামকে মঙ্গাকবলিত অভিধায় পরিচিতি দান করে। এই মঙ্গা উত্তরাঞ্চলের অনেকগুলো জেলায় প্রকট আকারে দেখা দিলেও সবচেয়ে বেশি ছিল কুড়িগ্রামে। বর্তমানে মঙ্গার ভয়াবহতা না থাকলেও দারিদ্র্য উঠে যায়নি।
এক শ্রেণির বেসরকারি সংস্থা কুড়িগ্রামের মঙ্গাকে পুঁজি করে মুনাফাভোগী হয়ে ওঠে। তারা অতিদরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বক্তব্যসর্বস্ব কিছু প্রকল্প করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়। এ পর্যন্ত মঙ্গা দূরীকরণে যত বেসরকারি সংস্থা কাজ করেছে, তা যদি প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়িত হতো তাহলে কুড়িগ্রাম দেশের সবচেয়ে ধনী জেলায় পরিণত হতো। কুড়িগ্রামের মানুষকে বিভিন্ন সময়ে সাময়িক সমস্যা নিরসনে সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু কুড়িগ্রামের মানুষ সাহায্যের পরিবর্তে কর্মসংস্থানের পথ খুঁজেছে। কিন্তু সরকার কুড়িগ্রামের মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সর্বশেষ সরকার কুড়িগ্রামে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’ নামের একটি প্রকল্প চালু করেছিল। এই প্রকল্পের অধীনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল, সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে যদি কোনো শিল্পকারখানা কিংবা কুড়িগ্রামের বন্যা রোধে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য রোধে অনেক বেশি কাজে লাগত।
কুড়িগ্রাম একটি প্রান্তিক জেলা। রাজধানী ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। সীমান্তবর্তী এ জেলার অভিশাপ ১৭টি নদী। এই নদী হতে পারত কুড়িগ্রামের জন্য আশীর্বাদ। যেহেতু দেশ নদীবান্ধব নয়, তাই নদীগুলোর ইতিবাচক দিক আমরা গ্রহণ করতে পারিনি।
অর্থনৈতিকভাবে কুড়িগ্রামে এমন সম্ভাবনা ধারণ করে আছে, যে কুড়িগ্রাম হতে পারে অল্প সময়ে দেশের অন্যতম উন্নত জেলা। চিলমারীতে যে বন্দর ছিল সেই বন্দর হতে পারত আন্তর্জাতিক মানের। কুড়িগ্রামে আন্তর্জাতিক মানের এ বন্দর কুড়িগ্রামের জনজীবনে উন্নয়ন বয়ে আনত। কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর রয়েছে। এই স্থলবন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশে-ভারতের ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব- জলপথ, সড়কপথ এবং রেলপথ। এই তিন পথেই বাংলাদেশ-ভারতের যোগাযোগ স্থাপন হতে পারে। সোনাহাট স্থলবন্দরের কাছেই বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদী। আবার মাত্র কয়েক কিলোমিটার রেলপথ স্থাপন করলেই রেল যোগাযোগ যুক্ত করা সম্ভব। সোনাহাট স্থলবন্দর হতে পারে ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত সাতটি প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রবেশ মুখ। বাংলাদেশ থেকে ভারত যেসব সামগ্রী আমদানি করতে চায়, সেগুলোভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে পারে কুড়িগ্রামে।
কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের প্রধানতম কারণ হচ্ছে বন্যা। প্রতিবছর বন্যায় কুড়িগ্রামের হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়। লাখ লাখ হেক্টর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। ডুবে যায় শস্যক্ষেত। এই ঘটনা প্রতিবছর কুড়িগ্রামে ঘটতেই থাকে। অথচ সরকার কোনো বছরই পরিসংখ্যান করে না এই ক্ষতির পরিমাণ কত। বন্যার সময় নামমাত্র ত্রাণ নিয়ে আসে সরকার। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
কুড়িগ্রামের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকার কথা ছিল কুড়িগ্রামের রাজনীতিবিদদের, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কুড়িগ্রামের রাজনীতিবিদরা কুড়িগ্রামের মানুষের ভোটসমর্থন নিয়ে ঢাকায় গিয়ে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কুড়িগ্রামের মানুষের কষ্টের দিনলিপি শোনার মতো তাঁদের কোনো সময়ই নেই।
দেশের উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণে বাজেটে সেই প্রতিফলন থাকা জরুরি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নে কুড়িগ্রামের অনটনকে প্রকট করার ব্যবস্থা থাকে, দূর করার নয়।
আমাদের দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সূচক হিসেবে রেমিটেন্স উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সেদিক বিবেচনা করলে কুড়িগ্রামের চিত্র করুণ। কারণ কুড়িগ্রাম জেলা থেকে যত কম সংখ্যক জনবল বিদেশে থাকে, এত কম সংখ্যক জনবল আর কোনো জেলা থেকে বিদেশে থাকে না।
কুড়িগ্রামের মানুষকে নির্ভর করতে হয় কৃষিতে। সেই কৃষি থেকে কৃষকেরা লাভবান হতে পারে না। তারও অন্যতম কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। কয়েকদিন আগে চিলমারীর এক বন্ধু নাহিদ হাসান ফেসবুকে লিখেছেন- তার এলাকায় বেগুনের মূল্য কেজিপ্রতি মাত্র চার টাকা। সেখানে অনেকেই মন্তব্য করেছেন সেই বেগুন ঢাকাসহ অনেক জায়গায় ২০ টাকারও ওপর। কুড়িগ্রামের রৌমারীতে সেই বেগুন মাত্র সাড়ে তিন টাকা কেজি। এসব স্থানে উৎপাদন ব্যয় বেশি। কিন্তু বিক্রির সময়ে দাম কম। দুদিক থেকেই কৃষকরা ক্ষতির শিকার হন।
বাস্তবতার নিরিখে বলা যায় কুড়িগ্রামের কোনো অভিভাবক নেই। তাত্ত্বিকভাবে কিংবা কাগুজে অভিভাবক আছেন, তাঁরা অনেকটাই মৌসুমি অভিভাবক। খরা-বন্যায় তাঁদের পাওয়া যাবে না। যখন ভোটের প্রয়োজন হয়, তখন তাঁরা অনেকটাই জনদরদির চরিত্রে অভিনয় করেন মাত্র। আমাদের দেশে যাঁরা মন্ত্রী আছেন, তাঁদেরও বোধ করি এসব ভাবার সময় নেই। যে বৈষম্য দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৪ বছরে দূর হয়নি, নতুন করে সেই বৈষম্য দূরীকরণের দায়িত্ব নতুন করে নেওয়ার আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে না। পিছিয়ে থাকা জনগণকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার কথা সংবিধান স্বীকৃত। তারপরও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র বরাবরের মতো থেকেছে নির্বিকার।
যদি কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে সরকার সচেষ্ট হয় তাহলে খুব সহজেই তা করা সম্ভব। সে জন্য কুড়িগ্রামের নদীভাঙন রোধে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দিয়ে কম খরচে অথবা স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে বেকার যুবকদের বিদেশে পাঠাতে হবে। ঢাকার সঙ্গে সহজ যোগাযোগের জন্য কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা আন্তনগর ট্রেন দিতে হবে। কুড়িগামের নয়টি উপজেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে বেকার যুবকদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে প্রযুক্তিনির্ভর কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে কুড়িগ্রামের অভিভাবক না থাকলেও সরকারকেই এ জেলার প্রকৃত অভিভাবকত্ব গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর