খোলা চোখে
একুশের বইমেলা, ঐতিহ্যের অংশ
একুশের বইমেলা এখন আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাস হলো বাঙালির ভাষার মাস। সেই ভাষার মাসের প্রথম দিন থেকেই বাংলা একাডেমি চত্বরে মাসব্যাপী বইমেলা শুরু হয়। আর রেওয়াজ অনুযায়ী এ বইমেলা দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করে থাকেন। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
যথারীতি ১ ফেব্রুয়ারি-২০১৬ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সেই মেলা উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বই হলো জ্ঞানার্জনের প্রধানতম মাধ্যম। আধুনিক এ ডিজিটাল যুগেও ছাপানো বইয়ের এতটুকু গুরুত্ব কমেনি; বরং দিন দিন মানসম্পন্ন বইয়ের কদর বেড়েই চলেছে। বাংলা ভাষা চর্চা, বাংলা ভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের গুরুদায়িত্ব নিয়ে ১৯৫৫ সালে ঢাকায় তৎকালীন বর্ধমান হাউস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বর্তমানে যা বাংলা একাডেমি হিসেবে বাঙালির হৃদয়-মনে স্থান পেয়ে এসেছে। গত বছরই (২০১৫) বাংলা একাডেমি তার জন্মের হীরকজয়ন্তী পর্বের অংশ হিসেবে ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান পালন করেছে।
বাংলা একাডেমির শুরু থেকেই কিন্তু এ ঐতিহ্যবাহী বইমেলা আরম্ভ হয়নি। কাজেই এ বইমেলা শুরুর কিছু ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, একসময় বাংলা একাডেমিতে চাকরি করা প্রয়াত কথাসাহিত্যিক, লেখক ও গবেষক সরদার জয়েনউদদীন, যিনি পরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হয়েছিলেন, তিনিই প্রথম বাংলা বইয়ের এ মেলার প্রচলন করেছিলেন। তিনি প্রথমে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি) নিচতলায় শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থা করেন। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১০ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে সেটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে তিনি তৃপ্ত হতে না পেরে পরে ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহায়তায় সেখানে একটি বইমেলা আয়োজন করেছিলেন। সে বইমেলার একটি বিশেষত্ব ছিল, সেখানে পুস্তক প্রদর্শনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনারও আয়োজন করেছিলেন তিনি।
তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালকে ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন সে বছরই ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা অয়োজন করা হয়। সে থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা। প্রাসঙ্গিকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বইমেলা সম্পর্কে একটু আলোকপাত করব। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী বইয়ের মেলা হিসেবে স্বীকৃত হলো জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুর্টের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বইমেলা। সে বইমেলাটি নাকি এখন থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে, অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল। কথিত আছে, জোহানেস গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কারের পরই ছাপার অক্ষরে বই ছাপানো শুরু হয়েছিল। আর সেই ছাপানো বই প্রদর্শন, প্রচার ও বিক্রির জন্য তখন থেকেই মেলার আয়োজন হয়ে আসছিল। মাত্র পাঁচ দিনের এই মেলায় তিন লক্ষাধিক দর্শনার্থী ও সাত সহস্রাধিক প্রকাশকের সমাগম ঘটে। তার পরে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের বইমেলাটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা বলা হয়ে থাকে। সে বইমেলাকে অবশ্য বইমেলা না বলে বইয়ের বাণিজ্যমেলাও বলা হয়ে থাকে। কারণ, মেলায় এসে পাঠক শুধু বই কিনবে এমনটিই নয়। এ মেলার মূল উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বব্যাপী কীভাবে ভালো বই ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটা। সেখানে প্রতিবছর দেড় শতাধিক দেশের প্রায় ২৩ হাজার প্রকাশক, গ্রন্থ বিক্রেতা, লিটারারি এজেন্ট, গ্রন্থাগারিক, গণমাধ্যম ও শিল্প সরবরাহকারীরা মেলায় অংশগ্রহণ করেন।
তার পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ হিসেবে খ্যাত কলকাতায় অনুষ্ঠিত বইমেলা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এটিকে পৃথিবীর বাংলা বইয়ের সবচেয়ে বড় মেলা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে লন্ডন মেলার মতো এটি কোনো বাণিজ্যিক বইমেলা নয়। প্রকৃত অর্থেই তা বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে আয়োজিত হয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া কলকাতা বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। সেখানে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে সেই বইমেলার আয়োজন হয়। সে অনুযায়ী এখন সেখানে বাংলা বইয়ের একটি মেলা চলমান। ২০১৩ সালে কলকাতা বইমেলায় বাংলদেশ ছিল থিম কান্ট্রি। তার পর ১৯৬৯ সাল থেকে চলে আসা আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা আয়োজিত হয়ে থাকে মিসরের কায়রো শহরে। আরবি, ইংরেজি ও আরো নানা ভাষায় সেখানে বই পাওয়া যায়। মস্কোতে ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হওয়া বইমেলাটি মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বৃক ফেয়ার নামে প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরের ৩ থেকে ৭ তারিখ এটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশেরই বইমেলা হলো তাদের দেশের জন্য একটি ঐতিহ্য।
বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এ বইমেলাকে সামনে রেখে দেশের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে যায় এ ফেব্রুয়ারি মাসে। একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে দেশের নামীদামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসহ হাজারো প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মব্যস্ততা বাড়িয়ে দেয়। সেখানে আগামী প্রকাশনী, আহমদ পাবলিশিং হাউস, মাওলা ব্রাদার্স, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঐতিহ্য প্রকাশনী, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতি কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই এখন বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন ডিজিটাল যুগে প্রকাশকদের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভার্চুয়াল বই, অর্থাৎ অনলাইন ইলেকট্রনিক বই। যাকে সহজেই ই-বুক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। তবে আশার কথা, যতই আধুনিক ও ডিজিটাল হোক না কেন, বই বলতে আসলে ছাপানো বইকেই বুঝিয়ে থাকে। কাজেই বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা থাকার পরও বইমেলায় যে উপচেপড়া ভিড় হয়েছে, তাতেই বইপ্রিয়তার চিত্র ফুটে ওঠে।
বই প্রকাশনাকে একটি শিল্প হিসেবে ধরলে এ শিল্পে প্রচুর সৃজনশীল মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। সৃজনশীল বললাম এ কারণে যে, বইয়ের মতো সৃজনশীল কাজে সৃজনশীল মানুষই কাজ করেন। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় একসময় বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হওয়া বইমেলার উপচেপড়া ভিড়ের অভিজ্ঞতায় এবার পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে মেলার স্থান হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
এবারের বইমেলার পরিধি বাড়ানো হয়েছে এবং স্টলগুলোকে চার স্তরে সাজানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মেলায় পাঁচ শতাধিক স্টল স্থাপনসহ ১৫টি ক্যাটাগরিতে এবারই প্রথম সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কর্তৃক একাধিক চতুর্মুখী গেট স্থাপন করা হয়েছে। অবাধে চলাচলের ক্ষেত্রে তা একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। এবারের বইমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বিগত কয়েক বছর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিশেষত, ২০১৩ সালের পর থেকে মেলাগুলো একটু সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, তা আমরা সবাই জানি। তা ছাড়া এই বইমেলাতেই স্বাধীন মত প্রকাশের অগ্রদূত বুদ্ধিজীবী ও লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। সে আঘাতের কারণে পরে তিনি বিদেশের মাটিতে মারাই গেলেন।
গত বছর বইমেলা চলাকালীন মুক্তমনের লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে সেই ড. অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের দায়ে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং একই সময়ে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ আরো অনেককে আক্রমণ করে গুরুতর আহত করা হয়েছে। আবার দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলমান। এরই মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের উসকে দেওয়ার জন্য শহীদের সংখ্যা নিয়ে নতুনভাবে বিতর্ক তোলা হয়েছে। ঠিক সে সময় এ বইমেলার সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বর্তমান বইপ্রেমী শেখ হাসিনার সরকার। কারণ, ব্যক্তি শেখ হাসিনা নিজেও একজন রুচিশীল লেখক এবং সৃজনশীল পাঠক। তিনি বইমেলা উদ্বোধন করতে এসে রীতিমতো তালিকা করে বিভিন্ন পছন্দের বই কিনে নিয়ে যান বাসার জন্য।
কাজেই ২০১৬ সালের বইমেলাও যে অত্যন্ত সফলভাবে সমাপ্ত হবে, সরকারের বিভিন্ন তৎপরতাসম্পন্ন উদ্যোগ দেখলে তা সহজেই অনুমেয়। বাঙালি যে পরিবেশ পেলে কীভাবে এসব জায়গায় উৎসবের আমেজ বাঁধভাঙা রাতের মতো ছুটতে শুরু করে দেয়, তা সদ্যসমাপ্ত ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কারণ, আমরা এমন অনেককে চিনি, যাঁরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন কখন তাঁদের সেই প্রাণের ফেব্রুয়ারি মাস আসবে। সেখানে গিয়ে তাঁরা উৎসবে মেতে উঠতে পারবেন। প্রকাশ করতে পারবেন নিজের বই, নয়তো কিনতে পারবেন নিজের পছন্দমতো বই। কাজেই ১ ফেব্রুয়ারি-২০১৬ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর যে বইমেলার যাত্রা শুরু হলো, তা অনায়াসে চলবে মাসজুড়ে। সেখানে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অপ্রত্যাশিত। সে ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি সব অংশগ্রহণকারী নাগরিককে সচেতনভাবে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।