সাগর-রুনি হত্যা
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে’
Our death is not an end if we can live on in our children and the younger generation. For they are us, our bodies are only wilted leaves on the tree of life. -Albert Einstien
বিশুষ্ক পাতাঝরা শীতের দিন শেষে প্রকৃতিতে নেশালাগা অমৃত বসন্ত সমাগত। কিন্তু আজ প্রকৃতির মন খারাপ করা ঝিমুনি আর শীতনিদ্রা যেন কিছুতেই কাটছে না। কুয়াশা অস্বচ্ছতায় আবদ্ধ শোকবিহবল আনত দৃষ্টিতে অশ্রুজলের সায়র। সুরটা সাধতেই পারছে না ঋতুবন্দনার হুইসেল ব্লোয়ার কৃষ্ণকায় সুকণ্ঠী কোকিল। ওহে চিরজাগরুক মৃত প্রাণপ্রদীপ একবার জ্বলে ওঠো। দেখে যাও, কেমন উথাল-পাথাল চলছে আজ ৯ বছরের শিশু মাহির সারোয়ার মেঘের মনে। তা জানে কেবল নীড় হারা পাখিরা। জানে চাপিয়ে দেওয়া বঞ্চনায় পিষ্ট নিঃস্ব মানবেরা।
চার বছর আগে ঠিক এমন একটি দিনেই দুর্ভাগা ও মনপোড়া মেঘকে বাবা মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ারের পরম আশ্রয় ও মা এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির অনিঃশেষ মমতা থেকে বঞ্চিত করেছিল কোনো এক অস্পৃশ্য অন্ধকার জগতের হায়েনারা। কখনো কখনো সেই হায়েনারাও রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়ে বিশাল হয়। রাষ্ট্রও হার মানে অন্ধকার হায়েনার কাছে এই বাংলাদেশে। ৪৮ ঘণ্টার হার মানা অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হয় ৩৫ হাজার ঘণ্টা ধরে বা তারও অধিক। তবে কি অসহায় ভীষণ বঞ্চিতজনেরা নিরন্তর বয়ে বেড়াতেই থাকবে প্রলম্বিত বিচার প্রার্থনার এমন দুর্বিষহ হাহাকার!
হে প্রবল সক্ষমতার উটপাখি কী জবাব আছে শিশু মেঘের কাছে তোমার? কী জবাব আছে নিজের বিবেকের কাছে? জানি নিরুত্তর তুমি এবং তোমরা!
জাতির স্থপতি ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে নির্মমতার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার এবং একাত্তরের পরাজিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয় এখানে এই প্রিয় বাংলাদেশেই। কলঙ্কমুক্ত আমরা। ওই মাপের না হোক, সাগর-রুনিও ছিল মানুষ অথবা মেঘের কাছে তারও বেশি। তবে তাদের বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদতেই থাকবে এই কেমন চেপে বসা কৃত্রিম নিয়তি হৃদয়ে রক্তঝরা সুশান্ত মেঘের?
তবে মহান ঈশ্বরের ঝুলিতেও কি কেবল ব্যর্থতারই গ্লানি? হয়তো তাই।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় মৃত্যুর বিভীষিকা ও অনিবার্য শূন্যতা উপলব্ধি করেছিল অতিকান্নায় চোখে জলহীন মেঘ। সেদিন রাতে মহান ও পরাক্রমশালী ঈশ্বর সাগর ও রুনির আত্মাকে বলেছিলেন, বেরোও। আত্মারা বলেছিল, আমরা স্বেচ্ছায় বেরোব না। প্রভু বললেন, অনিচ্ছায় হলেও বেরোও। প্রভুর চাপে দুটি সতেজ সজীব উচ্ছ্বল আত্মা দেহ থেকে বেরোলে চারজন ফেরেশতা শূন্যে ভাসমান আত্মা দুটির সঙ্গে দেখা করে তা গ্রহণ করে ঊর্ধ্বে আরোহন করে। অন্ধকারের বাসিন্দা দুর্বৃত্তের খেয়ালিপনা ও চরম নির্মমতায় বেরোনো মেঘের কান্নাভেজা তারই বাবা-মায়ের আত্মার সুগন্ধে প্রভুর আস্তানা সুবাসিত। আসমানবাসীরা সমস্বরে উচ্চারণ করে, পৃথিবী থেকে দুটি পবিত্র রুহের আগমন ঘটেছে। হে রুহ! তোমাদের প্রতি এবং যে দেহ তোমরা আবাদ করেছিলে তার প্রতি মহান প্রভুর শান্তি বর্ষিত হোক। অনন্তর প্রতিপালক কেয়ামত পর্যন্ত আত্মা দুটিকে যত্নে রাখার জন্য নির্দেশ দেন। ধর্মমতে দেহাতীত আত্মার গতিটা এমন সুখকর ছিল বটে। তবে অস্পৃশ্য হায়েনাদের সহায়তায় আত্মাকে দেহচ্যুত হতে বলেছিলেন প্রভু। বলা যায়, মহান প্রভুর সেদিন ওই হায়েনাদেরই পরম মিত্র ছিলেন। একে প্রভুর ব্যর্থতার গ্লানি না বলুন অন্তত রহমত বলবেন না!
ভয়ংকরভাবেই দেখা যাচ্ছে, দুর্বৃত্তদের পক্ষাবলম্বনে রাষ্ট্রযন্ত্র আর প্রভুর কারিকুলাম সেদিন মিলে গিয়েছিল সোনায় সোহাগায়। সাগর-রুনির করুণ মৃত্যু নিয়ে ঈশ্বর ও সরকারের এমনতর মাসতুতো ভাই কারবার চলেছে, চলছে আর আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হওয়া দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকার ফেনিল সমুদ্রের মতোই বাড়ছে কেবল।
আজ ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সাগর রুনির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে মাহির সারোয়ার মেঘ ও আমাদের শোকের এই দিনে জীবনানন্দ দাশই বড় বেশি প্রাসঙ্গিক-
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই
প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন