বই বিতর্ক
দুই মলাটের মধ্যে যারা বাঁচে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি সুবিধা এই যে, কোনো সংবাদ মনে হয় টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজের চেয়েও আগে আসে। এরপর শুরু হয় প্রতিক্রিয়া, তীব্র প্রতিক্রিয়া বা পাল্টা প্রতিক্রিয়া। সেদিন একজন ফেসবুকে মজা করে লিখেছেন এখন থেকে বই প্রকাশের আগে এক কপি বাংলা একাডেমি, এক কপি ডিএমপি আর এক কপি আদালতে জমা দিতে হবে। এসব জায়গা থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। অনেকটা সিনেমা সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার মতো। বেশ বলেছেন বটে লোকটা!
তবে সেটা কোথায় দাঁড়িয়ে বলছেন? বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান না, রমনা পার্কে বাদাম চিবুতে চিবুতে ফেসবুকের ফেক আইডি থেকে। কারণ তারও তো ৫৭ ধারার ভয় আছে। কথাটি এ কারণে বলা প্রবীণ রাজনীতিক লেখক ও প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিক, তার ভাই শামসুল আলমকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামের বই প্রকাশ করে তারা রাষ্ট্রের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেছে। একই সঙ্গে বইটি ছাপানোর জন্য শব্দকলি প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী ফকির তসলিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ব-দ্বীপ প্রকাশনা স্টলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মজার বিষয় হলো, এই বয়স্ক লোকদের আদালতে আনা হয়েছে হাতকড়া পরিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে এদের কাউকে আমি চিনি না বা দেখাও হয়নি। তা ছাড়া বিতর্কিত বই পড়ার আগ্রহ আমার কম বা লেখার আগ্রহ আরো কম। তবে পত্রিকা পড়ে যেটুকু জানতে পেরেছি, বইটি কোনো মৌলিক বই নয়, বিভিন্ন লেখকের লেখার সংকলন মাত্র। তবে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সচেতন মহল। তাদের অভিযোগ, প্রগতিশীল লোকদের বই বা তাদের প্রকাশনার প্রতি বাংলা একাডেমি বিরাগভাজন হলেও মৌলবাদী অনেক প্রকাশক বা জামায়াত-হেফাজত ঘরনার লেখকদের লেখা বই দেদারসে চলছে। দীপন হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের টুটুলসহ আরো কয়েকজনকে হত্যা চেষ্টার পর প্রগতিশীল অনেককে বলতে শুনেছিলাম, আমরা এমন কিছু না লিখি যাতে সমাজের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। হুম, কথাটা আংশিক মেনে নিলাম। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, যারা সমাজকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায় তাদেরও তো রুখতে হবে। যারা সমাজের সংস্কারের কথা বলে, বিজ্ঞানমনস্কতার কথা বলে, অন্ধকার থেকে আলোতে আসার কথা বলে, তাদের যদি আমরা ধরে ধরে গারদে পুরে দেই তাহলে মৌলবাদীদের আস্ফালন তো বাড়বেই।
ধর্ম নিয়ে কোনো বিতর্কিত লেখাকে আমি সমর্থন করি না। কারণ যাই ধারণ করে অস্তিত্ব ও সত্তাকে তাই ধর্ম। ধর্মে সবাই বাঁচে, বাড়ে। তবে যতই সময় গড়াচ্ছে ততই মনে হচ্ছে, আমরা কুপমণ্ডুক হয়ে যাচ্ছি আর এর কারণ কি এমন হতে পারে রাজনৈতিক পরাধীনতা? রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে দেশের উন্নয়নের জন্য যাই করি না কেন তা ফলপ্রসূ হয় না কখনো। কাজেই অর্থনীতিতে যতই স্বনির্ভর হোক দেশ, প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা আর বাক্ স্বাধীনতা। এত কথা বলার কারণ হচ্ছে ব-দ্বীপ প্রকাশনী বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে অনেক প্রকাশকের মধ্যে কেমন যেন গোপন আতঙ্ক কাজ করছে। যারা একমাস ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মেলায় এসেছেন তেমন প্রকাশকরা চুপি চুপি স্টল থেকে নানা বই সরিয়ে নিচ্ছেন এমন খবরও আছে। আড়ালে-আবডালে নানা কথা বলছেন। যেহেতু এই এক মাস বাংলা একাডেমির নিয়মই সব তাই অনেকে হজমও করছেন নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজাল।
গেলবছর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল রোদেলা প্রকাশনীর স্টল। বইমেলার শেষের দিকে এসে খুন করা হয় অভিজিৎকে। কয়েক মাস আগে তাঁর প্রকাশক জাগৃতির দীপনকে হত্যা করা হয়, হত্যা চেষ্টা হয় টুটুলসহ কয়েকজনকে। না, বাংলা একাডেমি তাদের স্মরণে কোনো আয়োজন রাখেনি। হয়তো মনে করেছে বাড়াবাড়ি করেই তারা মরেছে! কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কালো কাপড়ে ঢাকা জাগৃতির সামনে দিয়ে যখন যাই, মনটা হু হু করে ওঠে। চারদিকে কালোতে মোড়া, স্টলে সেসব বই সঙ্গত কারণেই রাখা হয়নি সেগুলো ছাপানোর অভিযোগে তাঁকে খুন হতে হলো।
দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি ভেতরে বসে এই বই সেই বই নাড়েন, চলনে-বলনে তাকে দেখে মনে হয় ভয়ে কুঁকড়ে আছেন। এবার শুদ্বস্বরও তেমন নতুই বই প্রকাশ করেনি। তার মানে ভয় আমাদের মাঝে মাঝে ধীরে ধীরে চেপে বসেছে। মৌলবাদীরা সফল হতে চলছে আর রাষ্ট্রযন্ত্র মনে হয় জেনে বা না জেনে সেটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
কবিতা লিখে দাউদ হায়দার দেশান্তরী। তসলিমা প্রবাসী। জীবন দিতে হলো প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে। অভিজিৎকে মারা হলো। খুন হলেন বেশ কয়েকজন ব্লগার। এবার অবশ্য পুলিশ বলেছে, লেখক বা প্রকাশক কেউ চাইলেই তারা নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু বই বের করার কারণে এই সভ্য সময়ে কাউকে জেলে যেতে হয় বা পুলিশ হাতকড়া পরায় সেটা ভাবতেই কেমন যেন লাগে। আমরা কি লেখনীর জবাব লেখনীর মাধ্যমে দিতে পারি না। তাহলে যে বলা হয়, অসির চেয়ে মসি শক্তিশালী, সেটা তো শুধু প্রবাদই রয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক