ভাষার কথা
আঞ্চলিক ও প্রমিত ভাষা মৃত্যুপথযাত্রী!
রংপুর অঞ্চলের নিজস্ব একটি আঞ্চলিক ভাষা আছে। এই আঞ্চলিক ভাষা দিনের পর দিন মৃত্যুপথযাত্রীতে পরিণত হয়েছে। শুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এখন আর তেমন কোথাও দেখা যায় না। যখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না, পাড়ার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে টেলিভিশনে সিনেমা প্রচার করা হতো না তখন সাধারণ মানুষদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ছিল। ধীরে ধীরে ভাষার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র আঞ্চলিক ভাষার স্বতন্ত্র রূপ গ্রাস করে নিচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ দোষের কিছু নয়। তবে সেই ব্যবহার ক্ষেত্রবিশেষে হতে হবে। যেখানে প্রমিত ভাষার প্রয়োগ থাকা চাই, সেখানে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ রীতিমতো অশোভন।
ঢাকার মতো রংপুর অঞ্চলে নতুন প্রজন্মের ভাষারূপ খুব কানে লাগার মতো না হলেও ইংরেজি-হিন্দি-এফএম সংস্কৃতি প্রভাবিত মিশ্রিত ভাষা তারাও ব্যবহার করছে। আমাদের প্রমিত ভাষা শ্রুতিমধুর। যদি শুদ্ধ উচ্চারণ আর যথাযথ প্রক্ষেপণ হয়, তাহলে বাংলা ভাষার মাধুর্য বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের উচ্চারণ বিকৃতির কারণে সেই সুললিত ভাষা কাঠামো রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
কথায় আছে, এক অঞ্চলের বুলি অন্য অঞ্চলের গালি। রংপুর অঞ্চলের ভাষায় অনেক সময়ে তুমি সম্বোধন করা হয় সম্মানার্থে। কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ যথাস্থানে না হলে বিপত্তি রয়েছে। যেমন একবার এক পুলিশ কর্মকর্তা আমার কাছে অভিযোগ করেছিলেন এক রিকশাওয়ালা সম্পর্কে। তিনি রংপুর অঞ্চলে জীবনে তখন প্রথম এসেছেন। রিকশাওয়ালা নাকি তাকে তুমি সম্বোধন করে জানতে চেয়েছিলেন- ‘তুমি থানায় যাবে নাকি?’ পরে আমি যখন তাকে বুঝিয়ে বলি, তখন তিনি বিষয়টি উপলব্ধি করেন।
রাজশাহী অঞ্চলে অপরিচিতজনদের সাধারণত মামা বলে সম্বোধন করেন। অনেকেই প্রথমে মামা ডাক শুনে চমকে উঠতে পারেন। রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারে না। যেমন রংপুরকে অম্পুর বলে। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার অবশ্যই দোষের কিছু নয়। তবে তা হতে হবে উপযুক্ত পরিবেশে। যেমন যেখানে মান বাংলায় কথা বলা প্রয়োজন সেখানে যদি রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বলি মুই যাবান্ন (আমি যাব না), সেটা অশোভন।
ভাষার শুদ্ধ রূপ শেখার জন্য আমাদের পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুব জরুরি। যেহেতু আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন পর্যন্ত প্রথম প্রজন্ম হিসেবে লেখাপড়া করে, তাই পরিবার থেকে শুদ্ধ ভাষাজ্ঞান অর্জন অনেকের পক্ষে অসম্ভব। প্রতিষ্ঠান থেকে যে শুদ্ধ ভাষারূপ শেখা হবে তারও কোনো উপায় নেই। কারণ আমাদের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে যাঁরা শেখান, তাঁদের ভাষাজ্ঞান পর্যাপ্ত নেই। উচ্চ মাধ্যমিক-উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অবস্থা একই।
আমাদের কথ্যরূপ এবং লেখ্যরূপ উভয়টিরই করুণ দশা। রংপুর শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হামিদুল হক তিন-চার বছর আগে (বর্তমানে নায়েমের মহাপরিচালক) একবার ওই কলেজের শিক্ষকদের উচ্চারণ শেখানোর জন্য দিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে প্রশিক্ষক নুরুন্নবী শান্তর সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের বিভিন্ন বয়সী শিক্ষকরা কোনোরূপ ইতস্তত না করে সারা দিন ধরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেন। অধ্যক্ষ মহোদয় শেখার কোনো বয়স নেই- এই কথা বলে উদারতার পরিচয় দিয়ে নিজেও উপস্থিত থেকে উচ্চারণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর কলেজের শিক্ষকরা যেহেতু স্কুলশিক্ষকদের শেখান, তাই প্রথমত তাঁদের নিজেদের উচ্চারণ শেখাটা জরুরি। শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার জন্য আমাদের স্কুলশিক্ষকদের শুদ্ধ উচ্চারণে পারদর্শী করে তুলতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়টি সহজতর হবে।
বাংলা বানানের অবস্থাও শোচনীয়। বাংলা বানান না জানাটাকে অনেকেই গর্বেরই মনে করেন। সর্বত্রই ভুল বানানের ছড়াছড়ি। ভুল বানান দেখতে দেখতে অনেকেই এখন ভুলটাকেই শুদ্ধ বলে জানেন। যেমন লাইব্রেরি শব্দে অনেকেই দীর্ঘ ‘ঈ’ কার শুদ্ধ জানেন। সাইনবোর্ডের বানানে প্রচুর ভুল চোখে পড়ে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রণন’ নামের একটি সংগঠন থেকে রংপুর শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দোকানের সাইনবোর্ডের বানান শুদ্ধ করে লিখে দেয়। দেশে এ রকম বেশ কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। এ রকম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বানান শুদ্ধকরণে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
বানানের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে দেখেছি আমার পিএইচডি গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক খোন্দকার সিরাজুল হক স্যারকে। একবার আমার একটি আবেদনপত্রে বিষয় শব্দটি লেখার পর কোলনের স্থলে বিসর্গ দেখে তিনি অবাক হন। কম্পিউটার অপারেটর ভুল করেছে বললে তিনি আমার কাছ থেকে হাতে লেখা কপিটিতে কোলন ঠিক আছে দেখে বলেন, তারা তো ভুল করবে। তাদেরও শেখাতে হবে। অধ্যাপক খোন্দকার সিরাজুল হক স্যার অত্যন্ত শুদ্ধচারী। বর্তমানে তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। তাঁর পাশে বাংলা একাডেমি, সরকার কেউই দাঁড়ায়নি।
একটি গল্প প্রচলিত আছে- একবার কয়েকজন লোক একজন মন্ত্রীর কাছে গ্রীষ্মকালের দুপুরে গিয়েছিলেন দেখা করতে। মন্ত্রী মহোদয় তাঁদের বলেছিলেন ছোয়েটার (ছয়টার) পরে আসেন। সাক্ষাৎপ্রার্থীরা ‘ছোয়েটার পরে’ আসার অর্থ বুঝেছিলেন সোয়েটার পরে আসা। প্রচণ্ড গরমেও তখন তারা সোয়েটার পরে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। মন্ত্রী গ্রীষ্মকালে শীতের পোশাক পরা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করলে সবাই বলেন- আপনি আমাদের সোয়েটার পরে আসতে বলেছেন। মন্ত্রী মহোদয় তখন বলেছিলেন ‘ছোয়েটার পরে আসতে বলিনি, ছয়টার পরে আসতে বলেছি।’ আমাদের মন্ত্রী-শিক্ষক-সচিব সকল পর্যায়ে অধিকাংকেরই উচ্চারণ সমস্যা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তো বলতেন- আমাদের ছবচেয়ে বড় ছমস্যা, ভাছার (ভাষার) ছমস্যা।
বর্তমানে অনেকে চলচ্চিত্রে একপ্রকার জগাখিচুড়ি ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন। সেখানে মানভাষা, আঞ্চলিক ভাষা কোনোটারই স্বতন্ত্র রূপ রক্ষিত হয় না। অনেক চলচ্চিত্র পরিচালক আবার এটার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ভাষার এই বিকৃতির কারণে সুললিত শ্রুতিমধুর ভাষার বৈশিষ্ট্য নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক ভাষার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন হেতু তারও স্বতন্ত্র রূপ বজায় থাকছে না।
ভাষা শুদ্ধ রাখার জন্য যেখানে প্রমিত ভাষার ব্যবহার প্রয়োজন, সেখানে শুদ্ধ প্রমিত রূপ প্রয়োগ জরুরি। তেমনি যেখানে আঞ্চলিক রূপ প্রয়োগ প্রয়োজন, সেখানে শুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগও জরুরি। ভাষার শুদ্ধ রূপ বজায় রাখার ক্ষেত্রে আইনি নির্দেশনাও আছে। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ব্যক্তিপর্যায়ের সচেতনতাও অনিবার্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর