শামসুজ্জোহা মানিকের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড প্রসঙ্গে
পুস্তক প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার এবং তাঁদের পুলিশি হেফাজতে পাঠানোর ঘটনায় কয়েকটি জরুরি প্রশ্নের জবাব পাওয়া দরকার। কারণ বিষয়গুলো ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিনিরাপত্তা সম্পর্কিত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থার অপরিহার্য গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে।
‘ইসলাম বিতর্ক’ শিরোনামের একটি বই প্রকাশের জন্য পুলিশ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ তারিখে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকার একুশে বইমেলার ১৯১ নম্বর দোকান থেকে ব-দ্বীপ প্রকাশনের মালিক ও সংকলন গ্রন্থটির সম্পাদক শামসুজ্জোহা মানিক (৭৩), ছাপাখানা শব্দকলি প্রিন্টার্সের মালিক ফকির তসলিম উদ্দিন কাজল (৫৩) এবং ব-দ্বীপের বিপণন শাখার প্রধান শামসুল আলম চঞ্চলকে (৫১) গ্রেপ্তার করে। সেদিনই রাত প্রায় সাড়ে ৮টার দিকে তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
ওই মামলায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজত চেয়ে পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারিতে আদালতে আবেদন করেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক জাফর উল্লাহ বিশ্বাস। আবেদনের শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম আমিরুল হায়দার তিনজনকে বিভিন্ন মেয়াদে পুলিশি হেফাজতে পাঠানোর বা রিমান্ডের আদেশ দেন।
সাধারণত ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অপরাধের অভিযোগের সত্যতা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য তদন্ত চলাকালে আরো বেশি তথ্য জোগাড়, অপরাধের প্রকৃতি নির্ণয়, অভিযোগের ধরন সুনির্দিষ্টকরণ ইত্যাদি প্রয়োজনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করার বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে রয়েছে। কেননা তদন্ত এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধান হচ্ছে প্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা। ফলে গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয় না বলেই রিমান্ডের অর্থাৎ পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
পুলিশ রিমান্ড চাওয়া মাত্রই আদালত রিমান্ড দেন না বা দিতে পারেন না। এ জন্য আদালতকে আগে নিশ্চিত হতে হয়। কারণ কাউকে রিমান্ডে দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের বা ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু আইনগত দায়িত্ব আছে। একজন নিরীহ ব্যক্তিকে রিমান্ডে পাঠালে সে যেন নির্যাতনের শিকার না হয় বা জোর করে তার কাছ থেকে কেউ স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা আদালতের দায়িত্ব। তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী এবং রিমান্ড প্রদান সংক্রান্ত বিধিবিধান পর্যালোচনা করে আদালত আদেশ দেন। না হলে, সন্দেহজনক গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার অপব্যবহার হতে পারে। যার উদাহরণ এ দেশে কম নয়। এই বহুল অপব্যবহার বন্ধে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, রিমান্ড সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) আরো কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন বনাম রাষ্ট্রপক্ষের মামলায় বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চের দেওয়া ১৫টি নির্দেশনা এবং শফিউজ্জামান বনাম রাষ্ট্রগং মামলায় বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি শরিফউদ্দিন চাকলাদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চের দেওয়া ১১টি নির্দেশনা প্রণিধানযোগ্য।
শামসুজ্জোহা মানিককে সাধারণ কোনো ফৌজদারি অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাঁকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারা অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলায় পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো উপাদান নেই। কেননা, মামলায় ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেওয়ার মতো বিবরণসংবলিত পুস্তক রচনা ও প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়েছে। পুস্তক ও তার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ই আদালতের বিবেচনার বিষয়। বিচার চলাকালে অভিযোগ প্রমাণের জন্য পুস্তকের বিষয়বস্তুই যথেষ্ট। আদালত বিচার অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করার অধিকারী।
এখানে শামসুজ্জোহাকে বিচারের আগেই প্রচলিত আইনের অপব্যবহার হওয়ায় তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। এটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনারও লঙ্ঘন। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে অপ্রয়োজনীয়ও বটে।
যে বই সম্পাদনা ও প্রকাশনের জন্য শামসুজ্জোহা মানিকসহ মুদ্রাকর ও বিপণনকারীকে দায়ী করা হয়েছে, রাষ্ট্র সেটি বাজেয়াপ্ত করে বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করাই হতো আইনসম্মত। এখানে আইনের রক্ষক হিসেবে রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, যা ব্যক্তির মতপ্রকাশ ও তার জীবনে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতার প্রশ্নকে সামনে এনেছে। সেই সঙ্গে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক উপাদানহীনতার জন্ম দিয়েছে। এর অবসান হওয়া উচিত এবং পরিবর্তন হওয়া দরকার।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং কো-কনভেনর, গণতান্ত্রিক সংবিধান সংগ্রাম কমিটি