বিশ্ব নারী দিবস
নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার ও বহুমাত্রিক দায়বোধ
প্রায় বছর বিশেক আগে ঢাকার কাছেই মানিকগঞ্জের এক গ্রামে আমার প্রথম আঁতুড়ঘর দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেটি যদ্দূর মনে আছে, ছিল একটি জেলেপল্লী। যে গৃহস্থের কথা বলছি, তাঁদের অবস্থা দিন আনি দিন খাইয়ের চেয়ে একটু ভালো। মোটামুটি তিনবেলাই খাবার জোটে। টিনের বাড়ির বাইরে বাঁশের বেড়া আর পলিথিন দিয়ে তৈরি এক ঝুপড়ি। চারদিক ঢাকা, আলো-বাতাসের কোনো বালাই নেই। কাঁচা মেঝের ওপর ওই ঝুপড়ি দেখে আমি আঁতকে উঠেছিলাম। এই আঁতুড়ঘরেই প্রসূতিকে তাঁর সদ্যজাত সন্তানসহ থাকতে হবে বেশ কিছুদিন। নিয়মটা সম্ভবত একেক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে একেক রকম। প্রসূতি অশুচি, শাস্ত্রমতে সেই অশুচিকালের সময় পার না হওয়া পর্যন্ত নোংরা ঘরে তাঁর এই নির্বাসন চলবে।
আঁতুড়ঘরের অস্বাস্থ্যকর দশার কথা বইপত্রে পড়ে এসেছি। কিন্তু চোখে দেখার অভিজ্ঞতায় ভেতর থেকে উপলব্ধি করেছিলাম, যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশের মায়েরা কী অস্বাস্থ্যকর, নোংরা, অনিরাপদ পরিবেশে সন্তান জন্ম দিয়ে এসেছেন। যুগের সঙ্গে এই অবস্থার বেশ পরিবর্তন হলেও আমাদের গ্রামগঞ্জে যেখানে বাড়িতেই শিশুর জন্ম হয়, সেখানে পরিবেশ এখনো যে শতভাগ নিরাপদ—ব্যাপারটা মোটেই তা নয়।
বাংলার জনসংখ্যায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে যে কম ছিল, তার পেছনে উঁচু মাতৃমৃত্যু হার নিঃসন্দেহে একটা বড় কারণ। বর্তমানে নারী ও পুরুষ জনসংখ্যার অনুপাতে বৈষম্য যে দিন দিন কমে আসছে, তার পেছনেও তাই মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসের একটা বড় ভূমিকা আছে, বিশেষজ্ঞরাও এটাই বলছেন। ২০১১ সালে শেষ যে আদমশুমারি হয় তাতে নারী ও পুরুষের অনুপাত ছিল ১০০.৩, যার অর্থ প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ১০০.৩ জন। নারী ও পুরুষের সংখ্যার অনুপাতে যে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, তা পরিষ্কার হয় আগের দুটি আদমশুমারিতে উঠে আসা চিত্রটি দেখলে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে নারী ও পুরুষের অনুপাত ছিল ১০৬.১, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে ১০৬.১ জন পুরুষ। ২০০১ সালে এ অনুপাত ছিল ১০৬.৪।
অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে এ দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম ছিল। অথচ বিজ্ঞান বলছে, নবজাতক মৃত্যুর ক্ষেত্রে নারী শিশুর চেয়ে পুরুষ শিশুই মারা যায় সংখ্যায় বেশি। কারণ, রোগ ও অন্যান্য প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নারী শিশুর চেয়ে পুরুষ শিশুর সামর্থ্য প্রাকৃতিকভাবেই কম থাকে।
অর্থাৎ প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য নারীকে প্রকৃতি বেশি সামর্থ্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেও আমাদের সমাজের পরিবেশটাই এমন যে, নারী বেশি শক্তি নিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারে না। তাকে পরাজিত হতে হয়, যার চিত্র ফুটে ওঠে আদমশুমারির পরিসংখ্যানে।
আগেই বলেছি, বিশ্বে এ চিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ায় জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এরই মধ্যে এ চিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এসব দেশের অনেকগুলোতেই দেখা যাবে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। এর পেছনে এসব দেশের মাতৃমৃত্যু হার অত্যন্ত কম এবং নারীর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের সামর্থ্য দুটোই কাজ করেছে নিশ্চয়ই।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রটি দেখে নেওয়া যাক। ১৯৯১ সালে মাতৃমৃত্যু হার ছিল ৫৭৪, যার অর্থ প্রতি লাখ প্রসবে ৫৭৪ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০১ সালে এ হার ৩২২-এ নেমে আসে। ২০১০ সালে এ হার পাওয়া গেছে ১৯৪। এসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ ম্যাটার্নাল মর্টালিটি সার্ভে থেকে।
মাতৃমৃত্যু হার কমে আসার অর্থ একটাই—গর্ভধারণকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে নারীর যে চিকিৎসাসেবা, যত্ন ও পরিচর্যা প্রয়োজন হয়, তার মান এখন আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। এখন এ সেবার পুরোটা না হলেও অনেকটাই ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে গর্ভকালীন নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার সেবা দেওয়া হচ্ছে। গ্রাম পর্যায়ে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক—প্রতি ছয় হাজার জনের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিকেও গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা পরীক্ষা দেওয়া হয়। আরো আছে সরকারের স্যাটেলাইট ক্লিনিক, যেগুলো গ্রাম পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনার পরামর্শ ও গর্ভকালীন চেকআপ সেবা দিচ্ছে।
ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে গর্ভকালীন চেকআপের সময় স্বাস্থ্যকর্মীরা তৎক্ষণাৎ মায়েদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করে দেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। এর বাইরে বেসরকারি অনেক সংস্থাও বিভিন্ন ধরনের গর্ভকালীন ও প্রসূতি সেবা দিচ্ছে।
আবার এখনো আমাদের দেশে অনেক শিশু বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল দূরত্ব বিবেচনায় গর্ভবতী মাকে আর সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই বাড়িতে ধাত্রীর হাতেই শিশুর জন্ম হয়। পুরোনো দিনে অপ্রশিক্ষিত ধাত্রীদের হাতে অনেক শিশু ও মায়ের মৃত্যু হতো; কিন্তু পরবর্তীকালে এসে ধাত্রীদের ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফলে তাঁদের হাতেও দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। ধাত্রীরা কোনো জটিলতা বোধ করলে তক্ষুনি গর্ভবতীকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
অর্থাৎ বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে, আর তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি মোট জনসংখ্যায় নারী ও পুরুষের অনুপাত কাছাকাছি চলে আসার মধ্যে এবং মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস পাওয়ার মধ্যে।
যে কথায় এ লেখা শুরু করেছিলাম, ফিরে আসি সেখানেই। আমরা অস্বাস্থ্যকর আঁতুড়ঘর থেকে হাসপাতালে পৌঁছেছি; যেখানে তা সম্ভব হয়নি, সেখানে বাড়িতে প্রসবের পরিবেশ উন্নয়নে ধাত্রী প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পরিবারের সচেতনতার জন্যও নানা আয়োজন করেছি। কিন্তু আমাদের দেশের মাতৃস্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে আরো অনেক কিছুই করা বাকি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বাড়ির দূরত্ব একটা বড় প্রতিকূলতা। এর ফলে, বিশেষ করে জটিল প্রসবের ক্ষেত্রে মায়ের ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। অনেক মায়ের মৃত্যু হয় প্রসবজনিত জটিলতায় সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে। এখন পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু প্রসবের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। খুব কমসংখ্যক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই এ ব্যবস্থা আছে। ফলে অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় নেই এমন মায়ের ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দূর গ্রামের যেসব গর্ভবতী মায়ের এ সেবা প্রয়োজন, তাঁদের ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। সুতরাং মাতৃমৃত্যু হার আরো কমাতে হলে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এ-সংক্রান্ত সেবার মান আরো বাড়াতে হবে, আরো দ্রুত মায়ের কাছে সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
এ তো গেল মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব। অন্যদিকে এ ক্ষেত্রে পরিবারের দায়িত্বও কিন্তু কম নয়। সুস্থ শিশু প্রসবের জন্য প্রয়োজন সুস্থ মা, আর সে জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি তার পর্যাপ্ত পুষ্টিরও ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের, বিশেষ করে তাঁর স্বামীর পরিবারের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের প্রথাগত ভাবনা কিন্তু এরই বিপরীত। বাড়ির বউটিকে সুস্থ দেখতে আমাদের অনীহা, পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারে তাঁর অধিকার নেই—এই আমাদের সনাতন বিশ্বাস। পুরুষতান্ত্রিক এ ভাবনার সবচেয়ে বড় শিকার মা তো বটেই, তাঁর গর্ভস্থ শিশুটিও। অপুষ্ট মা যে অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয়, প্রসবের পর থেকেই তাঁকে যমের হাত থেকে রক্ষার জন্য সবার যুদ্ধ শুরু হয়। অথচ মায়ের কিছুটা যত্ন করলেই যে এই বিরাট ঝুঁকি থেকে আমরা বেঁচে যাব, এই উপলব্ধি এখনো আমাদের মধ্যে সর্বজনীনভাবে আসেনি।
পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ভারী কাজ না করা—এসবই সুস্থ-সবল গর্ভধারণ ও সুস্থ শিশু প্রসবের অপরিহার্য শর্ত। আর এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নয়, পরিবারেরই দায়িত্ব। মানুষ হিসেবে নারীর অধিকারের সঙ্গে অচ্ছেদ্য পারিবারিক যত্নের এই পরিপ্রেক্ষিত। তাই নারীর অধিকার বিষয়ে ব্যক্তি নারী নিজে, তাঁর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—সব স্তরে যখন সচেতনতার মাত্রা পূর্ণাঙ্গ হবে, তখনই দেশে নিরাপদ মাতৃত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক : সাংবাদিক, অনুবাদক ও গবেষক।