অভিমত
নারী ও লৈঙ্গিক রাজনীতি
৮ মার্চ ছিল বিশ্ব নারী দিবস। নিউইয়র্কের পোশাক কারখানার কর্মীরা এর সূচনা করেছিলেন। দৈনিক কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে আট ঘণ্টা নির্ধারণ, ন্যায্য মজুরি ও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে তারা সোচ্চার হয়েছিলেন; যেতে হয়েছিল কারাগারেও। নিজেদের অধিকার আদায়ে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ এভাবেই উঠে দাঁড়ান যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা। এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯১০ সালে জার্মানির নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন নারী দিবস পালনের ডাক দেন। কিন্তু এই শত বছরেও নারীর নিজস্ব অধিকার নামের অনুভবের কি আসলেই কোনো হেরফের ঘটেছে?
বরং এই উত্তরাধুনিক যুগে এসেও আমরা বড় বেদনায় অবলোকন করি নারী দিবসের অতি ভিন্নতর ও পুরোদস্তুর বিপরীত চেতনা।
পিতৃতান্ত্রিক বিধাতা পুরুষরা অতিশয় দয়াপরবশ হয়ে আজ ২৪ ঘণ্টার একটি দিন অন্তঃপুরবাসিনীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। বিভিন্ন মঞ্চে ব্যাপক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হবে। পত্রিকায় ললনা মঙ্গলবিষয়ক রঙিন ক্রোড়পত্র বের হবে। পুরুষের সঙ্গে নারীর সমতা সমতা করে গগনবিদারি চিৎকার উঠবে। মাত্র আজ একটা দিন। পক্ষান্তরে বছরের ৩৬৪ দিন নিজেদের করে উৎসব উদযাপনের জন্য আগলে রেখে দিয়েছেন আত্মগৌরবে গৌরবান্বিত মহাপুরুষরা। নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া অকৃতজ্ঞ পুরুষের তৈরি বিধি বিধান কিংবা ধর্মীয় সংস্কৃতি সবখানেই যেখানে নারী অতীব ফেলনা, সেখানে তার জন্য একটা দিবস দয়া করে বরাদ্দ করা হয়েছে শোকর গুজর করতে হবে বটে। নারীকে নারী হয়ে ওঠার জন্য এই দিবসটি বড়ই যথার্থ। নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ সিমোন দ্য বোভোয়ার যেমনটি জোর দিয়ে বলেছেন, কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং নারী হয়ে ওঠে।
নারীর একটা নিজস্ব সত্তা আছে, এটা পুরুষতন্ত্র কখনো স্বীকার করেনি। পুরুষের কাছে নারীর মূল্য কেবল তার শরীরের জন্য, তার ভূমিকার জন্য -স্ত্রী, মাতা বা দাসী হিসেবে, এর বেশি কিছু নয়। পুরুষ চিরকাল গৌরব বোধ করে এসেছে যে সে পুরুষ। কারণ তার কল্পনায় সে সব কিছুর প্রভু। পুরুষের চেতনায় অন্ধ, বিকলাঙ্গ, নির্বোধ পুরুষও নারীর ওপর অধিষ্ঠিত শ্রেষ্ঠ। সেই প্রবাদটি কে না জানে, সোনার আংটি বাঁকাও ভালো! এমন চেতনাধারী মহাপুরুষেরা নারীর জন্য একটা দিন ধার্য করেছেন। বহুত শুকরিয়া মহামহিম পুরুষকূল।
নারী ও পুরুষের সমতা সমতা নিয়ে গলা ফাটানো আওয়াজের এই যুগে আমাদের দেশে বড় দুই দলের প্রধান শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া নারী বলে এই বঙ্গভূমে নারীর ব্যাপক অধিকার রক্ষিত হয়েছে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। রাজনীতির গরম মাঠে পুরুষের মতামত না নিয়ে বা তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এই দুই নেত্রীর একচুলও নড়ার জো নেই। নেত্রীদ্বয়কে আপাতঃ স্বাধীন দেখালেও সহকর্মী পুরুষের ঈর্ষার আগুন নিয়ে খেলবার সক্ষমতা অর্জন নিয়েও তাদের মাথা ঘামাতে হয় বিস্তর। ওই দুই নারী নেত্রীর দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসন করার সক্ষমতা নিয়ে দল দুটির পুরুষ নেতারা ওপরে সরব থাকলেও, ভেতরে তারা গুঞ্জরণ তোলেন, সমালোচনা করেন। ঈর্ষাকাতর পুরুষ নেতারা মুখ বাঁকা করে ভ্রু কুচকে, ‘মাইয়া মানুষ আবার নেতা’ বলে তির্যক মন্তব্যের বানভাসিতেও প্রায়শ ভিজেন। দেশের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত আমাদের নারীদের অধিকার আসলে এমনটাই।
কিন্তু যে নারী এত লাখো পুরুষের জন্মদাতা তার এমন নিয়তি হওয়ার কী কথা ছিল? মানুষের সেই ভ্রূণকালে কেউ নির্দিষ্ট করে নারী বা পুরুষ ছিল না। অথবা নারী বা পুরুষ সৃষ্টিতে দুজনের ভূমিকাই পঞ্চাশ পঞ্চাশ অংশ নির্ধারিত। তারপরও কেবল পুরুষের স্বার্থপরতা এবং লিঙ্গ নিয়ে কূটিল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেই নারীর সঙ্গে এমনতর বৈষম্য যুগ যুগ ধরে চলছে। নারীকে দাবিয়ে রাখতে পুরুষের গভীর ষড়যন্ত্রেই তথাকথিত নারী দিবস উদযাপন করতে হয়। পুরুষের ভাষায় নারী ক্রিকেট, নারী ফুটবল, নারীনীতি বা নারী নিয়ে অগ্রগতি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পুরুষ সম্পাদকের পত্রিকায় সপ্তাহান্তে নারীমঞ্চ, নারীজগৎ নামে বিশেষ সংখ্যা বের করতে হয়। টেলিভিশনে সুন্দরীতমা বা অপরাজিতা নামে প্রোগ্রাম উপস্থাপন করতে হয়। এর বিপরীতে কখনো শোনা যাবে না, পুরুষ দিবস উদযাপিত হয়। পুং আলোচনা সভা, পুং ক্রিকেট কিংবা পত্রিকার পাতায় পুরুষালি সংখ্যা বা টেলিভিশনে ‘বীরপুরুষ’ জাতীয় কোনো বিশেষ প্রোগ্রাম থাকে না। কারণ পুরুষ নিজেকে প্রভু ঠাওরায় সবখানে। সবই যখন তার, বিশেষ কিছুর আর কী দরকার? পুরুষকে পুরুষ প্রভু হয়ে ওঠার এই লাইসেন্স তাকে দিয়েছে তার ধর্ম, তার সমাজ এবং তার নিজের রচিত বিধান। বাংলাদেশের সংসদে ঠেলেঠুলে সাকল্যে ৩০ জন নারী আইনপ্রণেতাকে পুরুষ রাজনীতিবিদরা দয়া করে স্থান দেন। সেখানে নারীর সমান অধিকার নিয়ে আইন পাস করতে গেলে যে ৩০০ : ৩০ ভোটে বাতিল হবেই তা নিশ্চিত করে বলা যায়। দয়া বা অনুকম্পা যেখানে মুখ্য সেখানে সমান অধিকারের কথামালা স্রেফ বাতুলতা মাত্র।
হাজার বছর ধরে পুরুষ তার প্রকৃতিগতভাবে প্রাপ্ত বিশেষ প্রত্যঙ্গের জন্য নারীর ওপর আধিপত্যবাদ প্রকাশ করে এসেছে। আনন্দ বা প্রজাতি উৎপাদনে প্রকৃতিগত কারণেই নারীকে থাকতে হয় নিষ্ক্রিয় নিষ্প্রভ। আনন্দ সমরে একেই নারীর পরাজয় বলে পুরুষ তার আদিপত্য ফলায়। পুরুষের শরীর ও তার ধর্মই তাকে শক্তি দেয় কয়েকগুণ বেশি। প্রায় সব বড় ধর্মেই আছে, স্বামীকে ক্ষমতাবান করা হয়েছে।
অকপটে পুরুষ নিজে সাধু সেজে যৌনকর্মীদের পতিতা বলে গালাগাল দিয়ে নারীর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলেও যৌথাচারী পুরুষকে কোথাও নিকৃষ্ট পতিত বলতে শোনা যায় না। পুরুষের নারীবিদ্বেষপনা এমনই নির্লজ্জ ও কপটতাপূর্ণ।
ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর রচিত ‘নারী’ গ্রন্থে সূচারুরূপে নারী নিয়ে পুরুষের হাজার বছরের সুবিধাবাদী রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম, সাধারণ বিশ্বাস এবং কখনো কখনো বিজ্ঞানও মনে করে যে, নারী-পুরুষের সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাদের শারীরিক পার্থক্য। কিন্তু আধুনিক ভ্রূণতাত্ত্বিকদের মতে, নারী ও পুরুষের উভয়েরই সূচনা ঘটে নারীরূপে। সপ্তম সপ্তাহে এসেই শুধু কোনো কোনো ভ্রূণ ক্রোমোসোম ভিন্নতার কারণে পুরুষ হয়ে ওঠে। নারী হচ্ছে শুরু থেকে নারী, পুরুষ হচ্ছে শুরুতে নারী তারপর পুরুষ। নারীর ডিম্বাণু ও পুরুষের শুক্রাণু – এই দুই ধরনের কোষের সম্মিলনে জীবন জ্বলে উঠলেও নারীর দায়কে অস্বীকার করে তাকে বলা হয় নিষ্ক্রিয়। পুরুষরা বিধান তৈরি করেছে। তাতে একচেটিয়া সুবিধা দেওয়া হয়ছে পুরুষকে। তারা মুখর হয়েছে নারীর নিন্দায়। জীবন সৃষ্টিতে শুক্রাণু-ডিম্বাণুর ভূমিকা সমান সমান হলেও মানুষের কৃতজ্ঞ থাকার কথা ছিল নারীর ডিম্বাণুর কাছে। কারণ প্রারম্ভিক জীবন লালনে ডিম্বাণুর ভূমিকা অনেক বেশি। ডিম্বাণুর ভেতর শুক্রাণু প্রবেশের পর ডিম্বাণু ভ্রূণটিকে লালন করে, পুষ্টি জোগায়, তাকে বিকশিত করে তোলে। প্রকৃতিগতভাবে নারীই জীবনের প্রধান স্রষ্টা বা মাতা হলেও ধর্মের কারবারী পুরুষরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে, লৈঙ্গিক রাজনীতির মাধ্যমে নারীকে করে রাখে দ্বিতীয় লিঙ্গ।
আজন্ম অধিকারবঞ্চিত নারীদের মধ্যে কোনো দান্তে নেই, শেকসপিয়র নেই, রবীন্দ্রনাথ নেই। নিউটন, আইনস্টাইন নেই। ভিঞ্চি, পিকাসো, প্লেটো, এরিস্টটল বা মার্কস নেই। কোনো প্রেরিত পুরুষও নেই। কিন্তু সত্য হচ্ছে পুরুষদের মধ্যেও এদের মানের লোক বেশি নেই। এ প্রসঙ্গে ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর রচিত ‘নারী’ সম্পর্কিত বাংলা ভাষার ধ্রুপদী গ্রন্থে আরো বলেছেন, নারীকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বলা যায় না নারী অশিক্ষিত। তাকে বিজ্ঞান থেকে বহিষ্কার করে বলা যায় না, নারী বিজ্ঞানে অনুপযুক্ত। নারীর কোনো সহজাত অযোগ্যতা নেই, তার সমস্ত অযোগ্যতা পুরুষের সৃষ্টি, সুপরিকল্পিত বা রাজনীতিক ষড়যন্ত্র।
এমন নিলাজ পুরুষ সম্পর্কে ফরাসি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক ও নারীবাদের প্রধান প্রবক্তা সিমোন দ্য বোভোয়ার এক গ্রন্থে বলেন, পুরুষের মুখে স্ত্রীলিঙ্গ কথাটি অবমাননাকর শোনায়, তবু পুরুষ তার পাশবিক স্বভাব সম্পর্কে লজ্জিত হয় না; বরং কেউ যদি তার সম্পর্কে বলে : সে পুরুষ! তখন সে গর্ববোধ করে। স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি অমর্যাদাকর, এ কারণে নয় যে এটি জোর দেয় নারীর ওপর পাশবিকতার ওপর, বরং এ জন্য যে এটি তাকে বন্দি করে রাখে তার লিঙ্গের মধ্যে।
কেবল পুরুষ নয়, সমাজের পরম পুরুষরাও সচেতনে অস্বীকার করেছেন নারীর একক অস্তিত্ব বা সম্পূর্ণ বাস্তবতা।
পুরুষের এক মহৎ প্রতিনিধি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যেমনটা বলেছেন,
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি। অথবা
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।
নিজের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়েও পরম পুরুষের কাছেও যখন নারী তার সম্পূর্ণতা আদায় করতে পারেনি, সেখানে আমরা সাধারণ সে কোন ছার।
যে নারীর রক্ত দুগ্ধপানে পরিপুষ্ট মানুষ আমি, তাকে সবার ওপরে স্থান দেওয়ার মতো ঔদার্য নাই বা হলো। নারীর রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সকল নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হয়ে আসুন অন্তত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমোঘ পঙক্তিমালা মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও চর্চা করি।
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন