ব্যাংকে হ্যাকিং
অর্থ ফিরে পাব কি?
রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনায় অবশেষে পদত্যাগ করলেন (তাঁর ভাষায় স্বেচ্ছায়) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এ নিয়ে আপাত দৃষ্টিতে নাটকের ট্রেলার শেষ হলেও পুরো নাটকের বেশ কিছু বাকি রয়ে গেছে। তবে এ কথা ঠিক দুর্মুখেরা যে বলে থাকেন, এ দেশে দেহত্যাগের আগে কেউ পদত্যা করে না সেটা অনেকটাই ভুল প্রমাণ করলেন ড. আতিউর। ১৪ ও ১৫ মার্চ এই দুদিন এ নিয়ে টানটান উত্তেজনা ছিল, অবশেষে তিনি বললেন, ‘আমি বিবেক দ্বারা চালিত হই। আমি পদত্যাগ করলে যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভালো হয় তবে আমি পদত্যাগ করব।’পদত্যাগের পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘তৃপ্তির সাথে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বের হতে পারছি এটাই বড় বিষয়।’এ বিষয়ে তিনি নিজের নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও আনুগত্যের কথাও বলেন। এ পদত্যাগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। প্রধানমন্ত্রী প্রেস সচিবের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ‘এ পদত্যাগ নৈতিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত।’
নচিকেতার একটা গানের সারাংশ এই, বাবুদের ব্রিফকেস বা গৃহিণীদের সোনার নেকলেস চুরি গেলে আমরা সমম্বরে চিৎকার করে বলি ‘চোর, চোর’। অথচ ইমারতের ভিড়ে যারা বিকেলের সোনারোদ চুরি করে বা পুকুরচুরি থেকে শুরু করে কলমের খোঁচায় সাহেব-বাবু সেজে যারা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা তাদের কয়জনই বা ধরা পড়ে বা কয়জনেরই বা বিচার হয়। ব্যাংকের যারা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন বা যারা লোন নিয়েছেন তারা মাত্রই জানেন (সাধারণ গ্রাহকের ক্ষেত্রে) অল্প কিছু টাকা পাওনা হলেই ব্যাংক থেকে ঘন ঘন খুদেবার্তা পাঠান মোবাইল ফোনে বা ফোন করেন। এটা দায়িত্বের মধ্যেই হয়তো পড়ে। একবার পরিচিত এক গ্রাহক তেমনি সুন্দর কণ্ঠের এক মেয়ে ব্যাংকারের ফোন পেয়ে তাকে রাগের মাথায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আচ্ছা আপনারা আমার অল্প টাকা আদায়ের জন্য এত অস্থির হয়ে আছেন, আর এদিকে যে বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট হয়ে যাচ্ছে, হলমার্ক হাজার হাজার কোটি টাকা খেয়ে ফেলল, বড় বড় ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে তাদের কি কিছু হচ্ছে?’ কথার ধমকে মেয়েটি নাকি অনেকটাই কান্নার সুরে বলেছিলেন, ‘আমি স্যার ছোট কর্মচারী, আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? বড়দের জিজ্ঞাসা করেন!’ মোক্ষম জবাব বটে। তবে বড় বড় চুরি না হলে বড়দের নাম তেমন একটা আসে না।
রাজনীতির সংবাদ না থাকলে সংবাদ মাধ্যমে গরম(!) খবর পাওয়া কিছুটা মুশকিল। আমাদের দেশের মানুষ কিছু বুঝুক না বুঝুক ঘরের খেয়ে দেশোদ্ধারে বেশ পটু। কিন্তু এখন আলোচনায় রাজনীতি তেমন নেই। তাই হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ টাকা চুরির ঘটনা বেশ কয়েকদিন ধরে পত্রিকার হেডলাইন, টিভির শিরোনাম বা অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের সিলেক্টেড আইটেম থেকে নামছেই না। থামছে না নাটকীয়তা। সবার মুখে এখন একটাই প্রশ্ন, এই নাটকের শেষ কোথায়? শুধু কোনো বিশেষ ব্যক্তির পদত্যাগ বা কয়েকজনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? আমরা কি আমাদের হারানোর অর্থ ফেরত পাব? যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, কিছু অর্থ ফেরত এসেছে। ফিলিপাইনের রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলা হচ্ছে আবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, ‘অর্থ উদ্ধারে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনসহ অনেক বিশেষজ্ঞের মত, শ্রীলঙ্কায় যে অর্থগুলো পাচার হয়েছে সেগুলো হয়তো ফেরত আসতে পারে কিন্তু ফিলিপাইনে যা গেছে তা ফেরত আসা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে কারণ তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল।
এর আগে এটিএম কার্ড জালিয়াতি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলো। এর সঙ্গে যুক্ত বিদেশিসহ বেশ কয়েকজনকে ধরা হলো কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের সিস্টেমেই তো গলদ রয়েছে। সারা পৃথিবী যখন এটিএম কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে ম্যাগনেটিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে চিপস ব্যবস্থায় গেল আমরা তখন নানা অজুহাতে সেদিকে গেলাম না। আচ্ছা ঠিক আছে গেলাম না, তাহলে এতগুলো বুথ কেন অনুমোদন দেওয়া হলো? এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে পান-সিগারেটের দোকানের মতো ব্যাংকের এটিএম বুথ। অনেক বুথে টাকাও থাকে না ঠিকমতো। এসব তো গাফিলতি। এখন সবচেয়ে জমে উঠেছে রিজার্ভ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনা নিয়ে নানা নাটকীয়তা। ব্যাংক থেকে অর্থ চুরি হলো, জানলেন না অর্থমন্ত্রী। জানানো হলো না স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও। এটা বিস্ময়কর বটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হর্তাকর্তাদের সাহসের তারিফ করতে হয়। অথচ উচিত ছিল জানানো। তাহলে হয়তো দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া যেত।
বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘দেশে যখন সার্বিক উন্নয়ন ঘটছে তখন রির্জাভ ব্যাংকের টাকা চুরি যাওয়ার ঘটনা বা যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো বিমান পরিবহন না করাটা দুঃখজনক।’ অন্যদিকে অর্থমন্ত্রীও ক্ষেপে রয়েছেন কারণ তিনিও ঘটনাটা জেনেছেন অনেক পরে। তবে এ বিষয়ে অন্য বক্তব্য পাওয়া গেছে ড. আতিউর রহমানের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, অর্থমন্ত্রীকে তিনি লিখিতভাবে জানিয়েছেন অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন মৌখিকভাবে।
নাটক আরো জমে উঠেছে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই সুরে কথা কথা বলছেন। বিএনপি চাচ্ছে, গভর্নরের পদত্যাগসহ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত। তারা অবশ্য এর সঙ্গে যোগ করেছে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে না বললেও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুহ-উল- আলম লেনিন ও প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। এরই মাঝে আরেক নাটকের জন্ম দিয়েছেন তথাকথিত আইটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা। তিনি নিজেকে তদন্ত কমিটির লোক পরিচয় দিয়ে এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মত দেন। আমাদের কিছু কিছু মিডিয়া সেগুলো সাজিয়ে প্রচার করেন। কিন্তু আইসিটি বিভাগ থেকে জানানো হয় ‘এই নামে কেউ নেই।’ আপাত এই নাটকের অবসান হয়।
আসলে ইতিহাস এমনই নিষ্ঠুর। আতিউর যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হন তখন তাঁর জীবন সংগ্রামের কাহিনী তাঁর সততা নিয়ে কত না লেখালেখি। কিন্তু এখন সবাই তাঁকেই দোষবেন এটাই স্বাভাবিক। এই যে এখন খেলার মৌসুমের কথাই ধরি না কেন? এক সময় তামিমকে নিয়ে কত হাসাহাসি ‘ম্যাগি নুডলস’বানানো থেকে শুরু করে অশ্লীল কৌতুক পর্যন্ত। কিন্তু টি-টুয়োন্টিতে তাঁর ভালো ফর্মের কারণে সবাই আবার মেতেছে তামিম বন্দনায়। এটাই বাস্তবতা। তবে সবচেয়ে বড় কথা একটা নাটকের অবসান হলো কিন্তু রিজার্ভের যে অর্থ চুরি গেল তা যেন ফিরে পাওয়া যায় সেটাই ভাবতে হবে। ড. আতিউরের পদত্যাগের ডামাডোলে সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
লেখক : সাংবাদিক