নারী নির্যাতন
পাশবিকতার বিচার চাই
‘ধর্ষণ’ শব্দটা আমি নিতে পারি না। আমার শরীর গুলিয়ে ওঠে। বমি পায়। এই শব্দটা তাই আমি শুনতে পারি না। পড়তে পারি না। রেডিও-টিভির ধর্ষণসংক্রান্ত সংবাদ আমি শুনতে পারি না। উঠে চলে যাই বা চ্যানেল বদলে দিই। পত্রিকার নিউজও পড়তে পারি না। এটি কি এক ধরনের ফোবিয়া? এই ফোবিয়ার নাম কী? সব ধরনের ভীতিরই টার্ম আছে, এই ভীতির টার্ম কী?
সব ধরনের ভীতির যেমন টার্ম আছে, প্রীতিরও নিশ্চয়ই টার্ম রয়েছে। আচ্ছা, ধর্ষণ-প্রীতির কি কোনো টার্ম রয়েছে? ধরুন, যারা শুধু ধর্ষণের খবর জানার জন্য বা শোনার জন্য এ-সংক্রান্ত খবর পড়ে বা শোনে। বরং এই খবর পাঠের সময়ে এক ধরনের বিকৃত যৌন আনন্দ লাভ করে?
কথাটা কি আপত্তিকর হয়ে গেল!
না, আপত্তিকর হয়নি! এ ধরনের লোকজন রয়েছে। আমাদের আশপাশেই রয়েছে। শুনেছি, ধর্ষণ মামলাগুলোতে উকিল যখন জেরা করেন, সেসব জেরাজুড়ে অপ্রাসঙ্গিক বিকৃত রুচির যৌন সুড়সুড়িমূলক প্রশ্ন থাকে! একজন ধর্ষিত নারী, এই প্রক্রিয়ায় আবারও ধর্ষিত হন! বারবার! বারবার!
এ প্রসঙ্গের মানে কী?
মানে আছে। মানে এই যে ধর্ষণ, এই বিষয়টিকে কি আমরা নানা উপায়ে লালন করে আসছি কি না! সেদিন এক মেয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সে নানা প্রসঙ্গে তার বাবার প্রশংসা করছিল। জগতের আর সব পুরুষের নানা দোষের কথা বলছিল। আমি তাকে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে বললাম, 'ধরুন যদি এমন হয়, আপনার বাবা, ঠিক আপনার বয়সী কোনো একটি মেয়ের শরীরে বাসের ভিড়ে হাত দেয়!'
মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'ইউ ইন্সেইন! ইউ ম্যাড! হাউ ডেয়ার ইউ আর! আমার বাবাকে নিয়ে!'
আমি হাসলাম। হেসে বললাম, 'বিবিসির বা কাদের (স্পষ্ট মনে নেই) একটা গবেষণা প্রতিবেদন দেখলাম, ঢাকা শহরে বাসে যে পরিমাণ যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটে, তার শতকরা ৭৩ ভাগ বা তারও বেশি ঘটে চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষের দ্বারা! তো, আপনার বাবার বয়স আমার জানামতে চল্লিশের বেশিই।'
মেয়েটা এবারও চেঁচাল। আমি বললাম, 'চেঁচানোর কিছু নেই। আমার কথা শুনুন। এই যে এত এত পুরুষ, এই নিগ্রহে যুক্ত, এরা কি কারো বাবা নন? কারো ভাই নন? কারো সন্তান নন? নিশ্চয়ই তাঁদেরও আপনার মতো কন্যা রয়েছে। যে কন্যার কাছে তিনি ফেরেশতাতুল্য। তাহলে? তাঁরাও তাঁদের বাবাকে আপনার মতো ভালোবাসে, আপনার মতো ভাবে, তাঁর বাবা জগতের শ্রেষ্ঠতম বাবা, কারো ভাই, জগতের শ্রেষ্ঠতম ভাই, কারো সন্তান জগতের নিষ্পাপতম সন্তান! তাহলে?'
মেয়েটি এবার চুপ করে রইল। আমিও।
তবে আমার ভাবনারা চুপ করে রইল না। আজ যখন তনু নামের মেয়েটির সংবাদটি দেখলাম, সারা শরীর ভয়ে, আতঙ্কে, কষ্টে আড়ষ্ট হয়ে রইল। বারবার মেয়েটির মুখ ভেসে উঠছিল, ওই মুহূর্তের মুখ! কী তীব্র আতঙ্ক, কী তীব্র আর্তি, কী তীব্র কষ্ট নিয়ে মেয়েটা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। কাঁদছিল, হাত-পা ছুড়ছিল। সবকিছু শেষে যখন তার গলা কাঁটা হচ্ছিল, তখন মেয়েটি কী করছিল? আর ওই মানুষগুলো? তারা কী করছিল?
ওই তারা! কারো বাবা, কারো ভাই, কারো সন্তান ওই মানুষগুলো! কী করছিল? একমুহূর্তের জন্য ভাবেনি, এই মেয়েটি তার মেয়ে হতে পারত, তার বোন হতে পারত, তার মা হতে পারত! ঠিক এভাবেই তাদের জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ তার মা, বোন, সন্তানকে এভাবে ধর্ষণ শেষে গলা কেটে রেখে যেতে পারত! মনে পড়েনি? একমুহূর্তের জন্যও না? একমুহূর্তের জন্যও না?
তারা কি ঠিক ঠিক বাড়ি ফিরে গিয়ে মা বলে কোনো নারীকে ডেকেছে? বোনের সামনে দাঁড়িয়েছে? সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়েছে? স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে? সে ঘুমের ভেতর একবারও তনুর চিৎকার, তনুর ভয়ার্ত, আতঙ্কিত মুখ ভাসেনি? ভাত খেতে গিয়ে শরীর গুলিয়ে ওঠেনি! একবারও না?
যদি না উঠে থাকে, তবে এটি নিশ্চিত, এমন মানুষে গিজগিজ করছে আপনার চারপাশ। শুনেছি, তিন বছরের শিশুও ধর্ষিত হয়েছে! শুনেছেন? আশপাশে মানুষরূপে কী রয়েছে! কারা রয়েছে? তারাও কেবল সুযোগের অপেক্ষায়, আপনার মা, আপনার বোন, আপনার স্ত্রী-সন্তানও মুহূর্তে হয়ে উঠতে পারে একেকজন তনু। তারা সুযোগ পায় না বলে বাসে-ট্রেনে, রাস্তায় শিস কাটে, ফেসবুকে ইনবক্সে অশ্লীল ছবি পাঠায়। তারা অপেক্ষায় আপনার মতো ওত পেতে আছে! ধূর্ত নেকড়ের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খাবার অপেক্ষায়।
কিন্তু তনুদের তাতে লাভ কী? সেই তো মেয়ে, মেয়েশরীর! হ্যাঁ, শরীর! ওই মাংসের দলা শরীরটুকুই তো সব? আপনাকে মাংসাশী করে তোলে! তাহলে আর কী! হিংস্র-মাংসাশী পশুর শরীরজুড়েও মাংসের খিদে। আপনার শরীরেও। তাহলে? জানি, কোনো তফাৎ নেই একজন ধর্ষক আর হিংস্র-মাংসাশী পশুতে। তাহলে বিচারে কেন তফাৎ থাকবে?
বিচার চাই, বিচার! বিচারটাও হোক পশুর মতো, পাশবিক, জান্তব! মাংস খুবলে খাওয়া এসব মাংসাশী পশুর বিচারটাও হোক প্রকাশ্যে, ভয়ংকর যন্ত্রণায়, ভয়াবহ কষ্টের, আর্তনাদের। সেই বিচার মানুষ দেখুক, ভাবুক।
ভেবে ভেবে নিজের ঘরে যে তনুরা রয়েছে, তাদের জন্য বুকের ভেতর হাহাকার উঠুক। বোধ উঠুক। আর বোধ না উঠলে চোখের সামনের ওই সব জান্তব বিচার দেখে কেঁপে উঠুক ভয়ে!
তবুও মানুষ মানুষ হোক। মায়ায়, কিংবা আতঙ্কে...।
লেখক : তরুণ নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক।