জাগো বাহে
ভাওয়াইয়া আর কুশান পালা কি মরে যাবে?
বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার গান ভাওয়াইয়া। এ গানের ভাষা-সুর স্বতন্ত্র। একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভাষায় এই গান বাঁধা হলেও এর সুরবৈশিষ্ট্য দেশের সকল অঞ্চলের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রংপুর অঞ্চলের ভাষাকাঠামো আর ভারতের কোচবিহারের ভাষাকাঠামো অভিন্ন। রংপুরে যে ভাওয়াইয়া গানের প্রচলন সেই গান বিস্তৃত ভারতের কোচবিহার আসাম পর্যন্ত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতে ভাওয়াইয়া গানের অনুশলীন বেশ ভালোভাবে হচ্ছে। সেখানে ভাওয়াইয়া চর্চার বেশ অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে ভাওয়াইয়ার চর্চা দিনের পর দিন কমে আসছে। ব্যক্তি উদ্যোগে, কোথাও কোথাও কিছু কিছু সংগঠন, কোথাও কোথাও পারিবারিকভাবে কিছু চর্চা ভাওয়াইয়া গানকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
ভাওয়াইয়া মূলত লোকগীতি। লোকমুখ এ গানের উৎস। বর্তমানে যে ভাওয়াইয়া গানগুলো গাওয়া হয় তার অনেকই সংগৃহীত গান হিসেবে গাওয়া হয়।
ভাওয়াইয়া গানের এক বিশিষ্ট শিল্পী কছিম উদ্দীন। নিজে গান গাইতেন এবং গান লিখতেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি নিতে পারেননি। তাঁর লেখা অনেক গান যথাযথভাবে সংকলন করা হয়নি বলে তাঁর সবগান আর পাওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো তিনি লিখেছেন, কিন্তু তিনি যে লিখেছেন তাঁর পক্ষে আর প্রমাণ নেই। তখন সে গানটিও গাওয়া হয় সংগৃহীত গান হিসেবে। এই বাস্তবতা মারা যাওয়া প্রায় সব গীতকারের জন্য প্রযোজ্য।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাওয়াইয়া গানের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। ভাওয়াইয়া গানের ভাষা রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা। যারা এখন শিক্ষিত হচ্ছেন তাঁরা আঞ্চলিক ভাষা থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছেন। তাঁরা গানের চর্চা করলেও ভাওয়াই গানের চর্চা করেন না। এখন যাঁরা ভাওয়াই গানের চর্চা করেন তারা বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। রংপুরের আঞ্চলিকতাকে ধারণ করতে না পারলে, আঞ্চলিকতার প্রবণতাকে রপ্ত করতে না পারলে ভাওয়াইয়া গানের মূল সুরে উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে যাঁরা আঞ্চলিকতা থেকে সরে যাচ্ছেন তাঁরা ক্রমাগত ভাওয়াইয়া থেকেও সরে যাচ্ছেন।
কুড়িগ্রাম, লালমনির হাট এবং রংপুরের মধ্যে এখন পর্যন্ত কিছু কিছু ভাওয়াই চর্চা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ বেতার রংপুর ভাওয়াইয়া গানের কিছুটা চর্চা ধরে রেখেছে। নিয়মিত ভাওয়াইয়া গান পরিবেশনের অনুষ্ঠান থাকার কারণে কিছু কিছু শিল্পী ভাওয়াইয়ার মধ্যে রয়েছেন।
ভাওয়াইয়া গানের গীতিকার যারা মারা গেছেন তাদের অনেকেরই জীবনী সংকলিত না থাকার কারণে তাঁদের সম্পর্কে আর বিস্তারিত জানা যায় না। শিল্পীদের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। গীতিকার-শিল্পী-গীতি কোনোটিই ঠিকমতো সংকলিত হয়নি। বর্তমানে সরকারিভাবে সামান্য যে পরিচর্যা আছে তা বাড়াতে হবে। তা নাহলে আব্বাস উদ্দীনের ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে কিংবা ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে- গানগুলোর মতো কালজয়ী গানগুলোর সমাধি রচিত হবে। একটি গানে প্রায় সব পাখির নাম, অন্য একটি গানে প্রায় সব মাছের নাম রয়েছে। বাংলা গানের ইতিহাসে এ গান দুটো ভিন্ন মাত্রার গান। এ রকম অসংখ্য ভাওয়াই গান আছে যেগুলো বাংলা গানের ধারায় অনন্য সংযোজন।
নিজস্ব উপস্থাপন রীতিতে কুশান পালা পরিবেশিত হয়। রংপুর অঞ্চলে এ গানের আর মাত্র দুটি দল রয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই ধারার পালার সমাধি রচিত হতে চলেছে। কৃপার সিন্ধুর কুশান পালা আর অনন্ত দেবের কুশান পালার দুটি দল বর্তমানে কোনো রকম বেঁচে আছে। কুশান পালায় যারা অভিনয় করেন, নৃত্য করেন তারা একেবারেই মাঠের মানুষ। অনেকেই দিনমজুর। মেয়ের চরিত্রে ছেলেরাই অভিনয় করেন। কৃপা সিন্ধু রামায়ণের কাহিনী কুশান পালায় রূপ দিয়েছেন। তাঁদের বিষয় জানিয়ে দিলে তারা সেই বিষয়ের ওপরও পালাগান করতে পারেন। তাঁদের দক্ষ শিল্পভঙ্গি দর্শকদের মুগ্ধ করে। এ রকম বিনোদন সঞ্চারী পালাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পিছনে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই বড় হয়ে দেখা দেয়।
সব ভাওয়াইয়া গানের একটি সংকলন থাকা খুবই জুরুরি। বিশেষ করে যে গানগুলো সংগৃহীত হিসেব গাওয়া হচ্ছে সেগুলো। যে গানগুলোর গীতিকার রয়েছেন সে গানগুলোরও সংকলন থাকা প্রয়োজন। তা না হলে গীতিকারের মৃত্যুর পর তাঁর অনেক গান সংগৃহীত গান হিসেবে গাওয়া হয়ে থাকে।
ভাওয়াইয়া গানকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সাধারণ খেটে খাওয়া শিল্পীদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বেতার-টেলিভিশনে তারা যে গান করেন তাঁদের সম্মানি বাড়াতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক ভাওয়াইয়া গানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এককথায় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে শিল্পীদের যথাযথ সম্মান দিয়ে শিল্পের সাথে বাঁধতে হবে। নয়তো ভাওয়াইয়া গান কিংবা কুশান পালা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। এ সবের বাস্তবতা হবে কেবলি অতীত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।