মে দিবস
শ্রমিকের জন্য ন্যায্যতা ভাবনা
এ দেশের শ্রমবাজারের মূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে দেশ-বিদেশের শ্রমিকের ঘামে অর্জিত পণ্যদ্রব্যের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি বেশ উচ্চকণ্ঠে বিবৃত হচ্ছে। গার্মেন্ট এবং অন্যান্য কল-কারখানা সব মিলিয়ে এ দেশে শ্রমিক রয়েছে প্রায় এক কোটির ওপর। শ্রমিকদের মাস শেষে বেতন-বোনাস পরিশোধ এবং স্বার্থ রক্ষা এখন আবশ্যক কর্তব্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৩০ লাখের বেশি শ্রমিক বর্তমানে পোশাকশিল্পে কাজ করছে। আর একজন শ্রমিকের গড় আয় মাসে ৪০ ডলারের মতো। অথচ শেখ হাসিনা সরকার ২০১৩ সালে তাদের বেতন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা ধার্য করেছে। প্রতিবছর ১ মে এলে ছোট ও মাঝারি মানের কারখানায় বেতন-ভাতা সংক্রান্ত সমস্যার কথা উচ্চারিত হয়। সুযোগ-সুবিধা ও বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের কথা বলতে দেখা যায়। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা প্রাপ্তিতে ১ মে উপলক্ষে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত কী করতে পারে?
পৃথিবীব্যাপী পোশাকসহ বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমশোষণ করা হচ্ছে নির্বিকারচিত্তে। অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরেথরে সাজানো বাহারি সব পোশাক। দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ক্রেতাদের কজনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা? প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম। ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে। খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি। এমন সুযোগ তারা হাতছাড়া করেনি। কম টাকায় পণ্য কেনার কারণে শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ এসব ব্যাপারে তাদের মনোযোগ ছিল না। মূলত বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়। শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারে শতাধিক কারখানা ছিল। শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ—সবই ছিল সেখানে। যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিল না সব সময়। সেখানেও একসময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাত। ১৯১১ সালে নিউইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ শ্রমিক। মৃতদের অধিকাংশই ছিল নারী। মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা—কোনো কিছুই বাংলাদেশের এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি এলাকায় পোশাক ও সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় এক লাখ ২০ হাজার নারীকে। দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তারা হাতে পায় ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা। সে হিসাবে মাস শেষে বেতন দাঁড়ায় এক হাজার ৮০০ টাকা।
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ। তিন লাখের মতো পোশাকশ্রমিক আছে সে দেশে। কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড়জোর পাঁচ হাজার টাকা। সে দেশে মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদাপ্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছে এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে। তবে পোশাকশিল্পে চীন বিপ্লব সাধন করেছে। রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো, শ্রমিকদের মজুরিও বেশি। চীনে একজন পোশাকশ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্যমতে, চীনে পোশাকশ্রমিকদের মাসিক মজুরি ১৩৮ ডলার, কম্বোডিয়াতে ৭৫ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ৭১ ডলার, ভিয়েতনামে ৬৭ ডলার, ভারতে ৬৫ ডলার ও বাংলাদেশে মাত্র ৩৮ ডলার। যদিও এখন বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি মাসিক ৪০ ডলার, এই তথ্য নিবন্ধের শুরুতেই আমি দিয়েছি।
বর্তমান সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। অনেক শ্রমিক জানে না, তাদের ভবিষ্যৎ ভালোর দিকে যাচ্ছে কি না। কারণ, শ্রম আইন এবং মজুরি বোর্ড পুরোপুরি কার্যকর নেই সব কারখানায়। অগ্নিনিরাপত্তাও পর্যাপ্ত নয়। এমনকি অনেক ভবন পুরোনো। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গার্মেন্ট কারখানায় নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, (২০১৪) গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ৩০ ভাগ নারী শ্রমিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার কারণেই তাদের এই শঙ্কা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যায় এক হাজার একশরও বেশি তৈরি পোশাককর্মী। দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি। ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে, মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
বর্তমানে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত চার হাজার ৩০০ কারখানার মধ্যে চালু রয়েছে প্রায় তিন হাজার ৩০০ কারখানা। এর বাইরে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্যভুক্ত কারখানা রয়েছে আরো প্রায় এক হাজার। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নতুন মজুরি কার্যকর হওয়ার পর প্রথমবারের মতো বর্ধিত নতুন মজুরির হিসাবে এসব কারখানাকে গত ঈদের মতো এই ঈদেও বোনাস দিতে হবে। আসলে নিম্নবর্গের শ্রমিকের দুর্দশা অপরিসীম। যেসব পোশাক কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, সেসব কারখানার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। এসব শ্রমিক তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায়ই রাজধানীর বিজিএমইএ ভবনের সামনে হাজির হয়। কিছুদিন আগেও বিজিএমইএ ভবনের সামনে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও দেনদরবার নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঈদের আগে তারা আন্দোলনে নামে। কারণ, সরকারের শত প্রচেষ্টার পরও রমজান মাসে বাজারে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকে। শ্রমিকরা সারা বছর যে বেতন-ভাতা পায়, তা দিয়ে কোনোরকম খেয়ে-পরে চলতে পারে। তাদের সঞ্চয় বলে কিছুই নেই। এ জন্য শ্রমিকদের বেতন-বোনাসসহ সব রকম পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া মে দিবসের ভাবনার প্রধান প্রতিপাদ্য হওয়া দরকার।
সরকার গঠিত পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বোর্ড এরই মধ্যে মাসিক মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা ধার্য করলেও গার্মেন্ট মালিকরা মাসিক মজুরি চার হাজার ৫০০ টাকার বেশি দিচ্ছে না। অন্যদিকে পোশাক তথা সারা দেশের সব শিল্প-কারখানার শ্রমিকরা মানুষের মতো বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ন্যূনতম মাসিক মজুরি আট হাজার টাকা দাবি করছে। বর্তমানে ছোট ও মাঝারি কারখানার পোশাকশ্রমিকরা মাসিক মজুরি হিসেবে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা পাচ্ছে, যা তাদের জীবনধারণের জন্য খুবই কম। অনেক পোশাকশ্রমিক ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা ওভারটাইমসহ কাজ করে মাসে মাত্র তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে, যা তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?
প্রতিবছর মে দিবসে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ব্যাপক আয়োজন করে শ্রমিকের স্বার্থের পক্ষে কথা বলে থাকে। পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তৎপর থাকে ওই মন্ত্রণালয়। কোনো শিল্পে গোলযোগের আশঙ্কা থাকলে কারখানাগুলো বিশেষ নজরদারিতে রাখে। যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিল্প জোনগুলোয় নিরাপত্তারক্ষী দ্বিগুণ করে থাকে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শিল্প পুলিশ দফায় দফায় শ্রমিক সংগঠন ও কারখানা মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে। একই সঙ্গে বেতন-বোনাস নিয়ে বহিরাগত কেউ যাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সতর্ক করে দেওয়া হয় সবাইকে। সরকার এরই মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের নতুন স্কেলে বেতন দিচ্ছে। সরকারের নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী তাদের ন্যূনতম বেতন ১০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। এদিক দিয়ে শ্রমিকরা সরকারি কর্মচারীদের থেকে পিছিয়েই আছে। তাই তাদের মজুরি চলতি বছর থেকে বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা দরকার। শ্রমিকের কাছে তার সামান্য বেতনের টাকাটাই কিন্তু সর্বস্ব। এই সর্বস্ব দিয়ে একজন শ্রমিক (শ্রমিকের ৮০ শতাংশই নারী) বাড়িতে দরিদ্র বৃদ্ধ বাবা-মাকে টাকা পাঠায়। ঢাকায় ঘর ভাড়া দেয়। নিজের জামাকাপড় কেনে, খাবার কিনে খায়। এই টাকাটা মালিক না দিলে শ্রমিককে ভাড়া না দেওয়ার ‘অপরাধে’ ঘর থেকে বিতাড়িত হতে হয়, না খেয়ে থাকতে হয় এবং বৃদ্ধ দরিদ্র বাবা-মাকেও গ্রামে না খেয়ে থাকতে হয়। এ জন্য অবিলম্বে শ্রমিকদের মজুরি ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করার জোর দাবি জানাচ্ছি। আর শ্রমিকদের বেতন বাড়লে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে এবং বাজারে অতিরিক্ত অর্থ প্রবেশের ফলে জাতীয় আয় তথা ব্যক্তি-প্রতি আয়ও বাড়বে।
লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।