জাগো বাহে
সিট খালি তবু ছাদভর্তি মানুষ
রংপুরের মডার্ন এলাকায় দাঁড়ালে এমন অনেক বাস দেখা যাবে, যে বাসগুলোর ছাদভর্তি মানুষ। ছাদে তিলার্ধ পরিমাণ জায়গা নেই। ছাদের যাত্রীদের হাতে কাস্তে এবং ধানের বোঝা কাঁধে নেওয়ার অনুষঙ্গ (বাঁকুয়া)। মনে হতে পারে গাদাগাদিভাবে বসে থাকা এ মানুষগুলো বাসের ভেতরে জায়গা পাননি, কিন্তু গন্তব্যে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। এই ভুল ভাঙবে যখন একটু এগিয়ে গিয়ে বাসের ভেতরটা দেখা যাবে। অধিকাংশ বাসের ভেতরে সিট খালি পড়ে আছে। কিন্তু ছাদে কোনো স্থান নেই। এই দৃশ্য গোটা বছর দেখা যাবে না। বছরে চার মাস এই দৃশ্য দেখা যায়। আশ্বিন-কার্তিক এবং চৈত্র-বৈশাখ। যখন রংপুর মঙ্গার এলাকা বলে পরিচিত ছিল, তখন এই চার মাস ছিল সবচেয়ে দুর্বিষহ।
রংপুর অঞ্চলের মানুষ কৃষিনির্ভর। এই চার মাস জমিতে কোনো কাজ থাকে না। ফলে অধিকাংশ শ্রমিক হয়ে পড়েন কর্মহীন। যে সামান্য টাকা-পয়সা জমানো থাকে, তা দিয়ে এই বেকার সময় কাটে না। ফলে যখন জমানো টাকা-পয়সা শেষ হয়, তখন তারা কাজের জন্য এলাকা ছেড়ে যেখানে কাজ পাওয়া যায় সেখানে চলে যায়।
রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ কয়েকটি জেলার শ্রমজীবী এই সাধারণ মানুষ বাসের ছাদের যাত্রী। সামান্য কয়েকটি টাকার অভাবে তারা ছাদে করেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। সাধারণ যাত্রীর কাছে যে ভাড়া নেওয়া হয়, ছাদের যাত্রীদের কাছে তার তিন-চার ভাগের এক ভাগ ভাড়া নেওয়া হয়। বগুড়া, টাঙ্গাইল, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে ধান পাকে রংপুর অঞ্চলের চেয়েও প্রায় এক মাস আগে। এই শ্রমিকরা ওই সব এলাকায় ধান কাটার কাজ করেন।
দীর্ঘদিন থেকে রংপুর অঞ্চলের মানুষ চার মাস কর্মহীন থাকেন। এই চার মাস তাঁদের শ্রম বিনিয়োগের জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যেত, তাহলে অন্তত তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত ভ্রমণ করতে হতো না। তাঁরা যখন বিভিন্ন এলাকায় যান, তাঁরা জানেন না যে ওই সব এলাকায় গেলে সন্তোষজনক কাজ পাবেন কি না। অনেক সময় তারা কাজ না পেয়ে ফিরে আসেন। অনেক সময়ে এমন সামান্য কাজ জোটে যে টাকায় তাঁদের যাওয়া-আসার অর্থটুকুও পাওয়া যায় না। যখন তাঁরা কাজ পান না, তখন এমনো হয়েছে ত্রিশ-চল্লিশ কিলোমিটার তারা হেঁটেই আসেন।
ছাদের ওপর উঠে ভ্রমণ করা আইনত নিষিদ্ধ। কখনো কখনো বাসের ছাদে এসব যাত্রীকে তুলে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। বলা যায়, মানুষকে পশুজ্ঞান করা। অনেক সময়ে দুর্ঘটনায় অকাতরে প্রাণ যায় এসব উন্নয়নের নায়কদের। দেশের উন্নয়ন সূচকগুলো হচ্ছে কৃষি, পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্স। এগুলোর মধ্যে অন্যতম কৃষি। কৃষিপ্রধান অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষির এই কারিগররা। অথচ তাঁদের জীবনের কত সামান্যই মূল্য! সময়-সমাজ-সভ্যতা সবকিছুই আধুনিকতার দিকে অগ্রসরমান। আর আমাদের শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়ন অবনমনের পথেই রয়েছে।
যে মানুষগুলো বাসের ছাদে জীবিকার তাগিদে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বাসের ছাদে করে ভ্রমণ করেন, তাঁরা প্রায় সবাই রংপুর বিভাগের মানুষ। রংপুর অঞ্চলের ভূমি খুবই উর্বর। রংপুর বিভাগে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। আর খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ। যে অঞ্চলের কৃষকরা বাংলাদেশের কৃষিতে এত বড় অবদান রাখছেন, তাঁদের রাখা হয়েছে সুবিধাবঞ্চিতদের তালিকায়।
প্রকৃত অর্থে শ্রমিকদের মূল্যায়ন করা হলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যাঁরা উন্নয়নের নায়ক হিসেবে বিবেচিত, তাঁদের এত করুণ অবস্থা হতো না। তাঁরা যে সরকারের কাছে দয়া-অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন তাও নয়। তাঁরা কর্মহীন সময়ে কর্ম চান। তাঁরা রিলিফ চান না, শ্রম বিনিয়োগ করতে চান। একসময়ে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় রাস্তার পাশে অনেক সাইনবোর্ড ছিল- ‘রিলিফ চাই না কাজ চাই।’
দেশে বিবিধ উন্নয়ন হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। এই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে মূলত ধনীদের ধনসম্পদ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। শ্রমজীবীদের ভাগ্যের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যদি দেশ এগিয়ে যেত, তাহলে বাসের ভেতরে সিট খালি রেখে বাসের ছাদে যাঁরা ভ্রমণ করেন, তাঁরাও বাসের ভেতরের যাত্রী হতে পারতেন।
লাখ লাখ কৃষিশ্রমিক যখন কর্মহীন হয়ে পড়েন, তখন রাষ্ট্র থাকে নির্বিকার। রাষ্ট্র যদি কর্মহীন দিনগুলোতে তাঁদের কাজের সংস্থান করত, তাহলে তাঁরা একটি নিরাপদ শ্রমক্ষেত্র পেতেন। একদিকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, অন্যদিকে রাষ্ট্র তাঁদের শ্রমকে রাষ্ট্রের কাজে ব্যবহার করতে পারত।
একসময়ে শুধু কৃষিশ্রমিকরা কাজের সন্ধানে যেতেন দূরে কোথাও। এখন এই কৃষিশ্রমিকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জেলে ও মাঝি। এই অঞ্চলের নদ-নদীগুলো জলশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণে জেলেদের মাছ ধরার উপায় থাকে না। একইভাবে যাঁরা নৌকা চালাতেন, তাঁদেরও কোনো কাজ থাকে না। তখন তাঁরা বাধ্য হয়ে বাসের ছাদে করে দূরে ছোটেন কাজের তাগিদে।
প্রতিবছর যখন বাজেট প্রণয়নের কাজ চলে, তখনই রংপুর অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলেন শ্রম বিক্রি করতে। বাজেট প্রণয়নের সময়ে এসব শ্রমিকের ভাগ্যের পটপরিবর্তনের লক্ষ্যে যদি সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করত, তাহলে সভ্য সমাজে কয়েকটি টাকার অভাবে মানুষ বাসের ছাদে করে যাতায়াত করত না। আমরা আছি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয়ের অপেক্ষায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর