রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
১.
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর কোল আলো করে চতুর্দশ সন্তান হিসেবে যে শুভ্র শিশুটি পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেছিল, তিনি আমাদের বাঙালির প্রাণের পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনের শেষ আলো নিভে যাওয়ার আগে যিনি লিখেছিলেন তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করে/ বিচিত্র ছলনা জালে হে ছলনাময়ী/ শেষ পুরষ্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভাণ্ডারে/ অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/ সে পায় তোমার হাতে শান্তি অক্ষয়/ অধিকার। আমরা আজ নিঃসঙ্কোচে সোৎসাহে বলতে পারি, সবিশেষ পুরষ্কারসমেত রবীন্দ্র দর্শনভাণ্ডার আজ অমর অক্ষয়।
আমাদের যা কিছু স্বপ্ন, ভাবনা, কল্পনা, বেদনা, আনন্দ, কী উৎসব, কী বিষণ্ণতা, কী মন খারাপ, প্রেম, বিরহ-বিচ্ছেদ, কী ঋতুর রং বদল কিংবা শেষ বিদায়ের কাল; সবটা আগেই পড়ে রেখেছেন আমাদের বাংলা ভাষাশিল্পের শ্রেষ্ঠ জাদুকর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। যেকোনো পরিস্থিতিতেই রবীন্দ্র সাহিত্য সরোবরে অবগাহন করলেই মনে হবে, আহা! রবি কবি যে আমার মনের কথাটিই ঠিক ঠিক বলে রেখেছেন। সেই সাহিত্যপুরুষ রবীন্দ্রনাথ সবকালের সবসময়ের এত মানুষের মনের কথা কেমন করে ঠিক জেনে ফেলেছিলেন, তা এক অপার বিস্ময়! ১৮৮০ সালের দিকেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রের অরুণোদয় সম্পন্ন হলে বাংলা সাহিত্যশিল্পভাবনার দিগন্তচক্রবালেও অরুণোদয় ঘটে যায়।
কবি রবীন্দ্রনাথ সদা জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করেছেন। যার সংস্কারমুক্ত উদার আতিথ্যে মনুষত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি অকৃত্রিম সত্যতা লাভ করে। যেই চিত্তবৃত্তের আহ্বানে যুগে যুগে উচ্ছ্বসিত হতে থাকে বাঙালির মন, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ আর বাঙালির ভাষা। তিনি পরমস্রষ্টার কাছে সদাসর্বদা এই প্রার্থনা করতেন যে, বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন সবই এক হোক।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
২.
কবি সংগীতের অমীয় সুধায় বলেছেন, দূরে চলে গেলেও যেন তাঁকে মনে রাখি। আর সজ্ঞানে তিনি নিজেকে মনে রাখবার উপলক্ষও সৃষ্টি করে গেছেন। কবির ভাষায়, আহা আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে, কত পাখি গায়। এমন বলা না হলে যেন প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা বাঙালির বসন্তবরণটাই ঠিকঠাক হতো না। কবি যদি আহ্বান না করতেন, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো, তবে কী অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলিয়ে জ্বরা ব্যাধি দূরে সরিয়ে দিয়ে নতুনের আহ্বানে পহেলা বৈশাখ আমাদের ঘরে আসত? কবি যখন বলেন, মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে’। দয়িতার কাছে দয়িতের একলা দ্বারের পাশে বসিয়ে না রাখবার আকুতির মধ্য দিয়ে বাংলার রৌদ্রগ্রীষ্মে সজল ঘন বর্ষা নামে। এ যেন ধ্যানমগ্ন কবির ঋতুবন্দনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে বাংলার হাওয়া বদলের কারুকাজটাই সুচারুরূপে ঘটে। রবীন্দ্রনাথ যখন টগবগিয়ে ঘোড়ায় চেপে মাকে নিয়ে বিদেশ ঘুরতে ঘুরতে কোমলমতি শিশুকে বীরপুরুষ সাজান আমাদের প্রজন্মরা সেইবেলা দুরন্ত সাহসী হয়ে ওঠে।
রাবীন্দ্রিক ভাব ভালোবাসায় যদি উচ্চারণ না করা যায়, ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/ তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া/ চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি/ গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।’ তবে বাঙালির প্রেম যেন অপ্রকাশ্যই থেকে যায়। রবি কবির মতো করে যদি, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা/ এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা’ পঙ্ক্তিমালা হৃদয়ের তন্ত্রিতে সুর হয়ে বাজে, তবেই কেবল প্রেমের সুখপাখিদের ভালোবাসি ভালোবাসি বলে ডাকবার ফুরসৎ মিলতে পারে!
কবি তাঁর ১৪০০সাল কবিতায় আমাদের কালের কলাকারদের জন্য সনাতনকে গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে দূরদর্শী বার্তা রেখে গেছেন। কবি জানতেন তাঁকে মনে রেখে তাঁর কথাকে প্রাধান্য দিয়ে আগ্রহভরে প্রাসঙ্গিকতা ও অনিবার্যতায় রবীন্দ্রভূগোলেই ঘুরপাক খাবে নবীন প্রজন্মের তাঁর প্রিয় ভক্ত। কারণ কবি থাকছেন আমাদের কাছাকাছি ছায়ার মতন।
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি-
তবু মনে রেখো।
বাঙালিয়ানার প্রবল প্রাণশক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন সাম্প্রদায়িক ধর্মের চেয়ে হৃদয়- ধর্মই শ্রেষ্ঠ। যার মধ্যে হৃদয়ধর্মজাত সত্যবোধ নেই তার ধর্মাচারণ মিথ্যাচারণ মাত্র। আচার-ধর্ম ও মানব-সত্যের সংঘাতে রবীন্দ্র সাহিত্যে মানবসত্য লাভ করেছে বিপুল মহিমা। দুরাশা গল্পে যেমন আচারের আঘাতে হৃদয়ধর্মের ট্র্যাজেডি হয়ে উঠেছে মর্মস্পর্শী। আমরা এইধারার গল্পগুলো রসাস্বাদনে ভালোভাবে টের পাই রবীন্দ্রনাথের ধর্মনিরপেক্ষ হৃদয়বোধের আন্দোলনগাঁথা। পদ্মার বুকে বসে উদার বাংলার যে রূপ তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেটাই তাঁকে অনুপম হৃদয়বোধে উদ্দীপ্ত ও আন্দোলিত করেছিল। যে উদ্দীপনায় বাংলার নানা শ্রেণিপেশার মানুষ, তাদের সহজিয়া সারল্য, তাদের দুঃখ-দৈন্য, অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রিক সংঘাত প্রভৃতির অনুপুঙ্খ প্রতিবিম্বিতাই সারকথা। চাপিয়ে দেওয়া জোরজবরদস্তির আচার সর্বস্বতার দাম সেখানে একেবারেই গৌণ। মানুষের জীবন অত্যন্ত ব্যাপক বলেই রবীন্দ্রমানসটাই ছিল সেই ব্যাপকতার শুলোকসন্ধানী। যেখানে মানুষই একমাত্র ও শেষ কথা।
৩.
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা পণ্ডিত সুকুমার সেন আমাদের প্রাণের সখা রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাই যথার্থ বলেন, রবীন্দ্রনাথ জীবনের সর্বভূমির কবি। রবীন্দ্রনাথের মতো মনে-প্রাণে চিন্তায়-কর্মে দুঃখে-সুখে জীবনে-মরণে সমদৃষ্টিমান জীবনভাবক কবি মানুষের ইতিহাসে আর দেখা যায় না। শিল্পনৈপূণ্যে, সৃষ্টি-উৎকর্ষে এবং কর্ম-চিন্তা-আনন্দ-নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পূর্বজ কবি শিল্পীদের মধ্যে তিনজন কথঞ্চিৎ তুলনীয়-গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস, ইতালীয় শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং সংস্কৃত সাহিত্যের কবি কালিদাস।
পাঠ্য বিষয়ের ও পাঠ্য পুস্তকের বাইরের পাঠ্যে-অপাঠ্যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা প্রগাঢ়ভাবে অধিগত করেছিলেন। বোধের ষোলকলায় পূর্ণ করেছিলেন নিজের মনন ভাণ্ডার। কবিতা, গানে, কথায়, শিল্পভাবনায়, সুকুমার বৃত্তি চর্চায় কবি আমাদের কাছে পরশ পাথর হয়ে ওঠেছিলেন। যার পরশে যার নৈকট্যে আমরা এখন নিজেদের সুবর্ণরেখায় মিলিয়ে নিতে পারি।
কবি যখন এক অনবদ্য অমৃত মন্থনে তাঁর কাব্যসুধায় আনন্দের ফুল তুলে বেছে বেছে মালা গাঁথেন তখন তাই হয়ে ওঠে জীবনসাধনার মর্মকথা। কবিসত্তার সাধন ব্যাকুলতা নিয়ে কবি তাই গীতাঞ্জলিতে উচ্চারণ করেন, জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দ-গান বাজে/ সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া মাঝে। এমনি করেই বাউল শিরোমণি ফকির লালন সাঁই, সাধক ও সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, লেখক মীর মশাররফ হোসেন, বিপ্লবী বাঘা যতীনসহ অসংখ্য গুণী মানুষের প্রাণের আবেশ ছড়ানো জনপদ কুষ্টিয়ার শিলাইদহের রবিকবি আমাদের প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠেন। কবিকণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তাই আমরা আজ বলতে পারি :
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে॥
আছে সে নয়নতারায় আলোকধারায়, তাই না হারায়-
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে॥
কবির সহস্র গান, অজস্য কবিতা কথা, দর্শনতত্ত্বের লাখো শব্দসম্ভার সবকিছু একপাশে রেখে তিনি যখন প্রবল দেশাত্মবোধে বাংলা মাকে ভালোবেসে উচ্চারণ করেন, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি/ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’- তখনই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাঙালি মানুষের আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠেন। বাঙালির মনন ও চেতনাজুড়ে রয়েছে যে রবিমানস, সেই আত্মার আত্মীয়র শুভ জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রাণান্ত ভালোবাসায়- প্রণতি জানাই হে প্রিয় কবিগুরু।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন