জাগো বাহে
রংপুরের রেলের প্রতি অবহেলা আর কতকাল?
রংপুরের রেলব্যবস্থা নিয়ে কোনো সরকারের কখনোই কোনো মাথাব্যথা ছিল না, এখনো নেই। রংপুরের রেল কেমন চলছে, এটা দেখার জন্য কেউ একজন যদি রংপুরে যে ট্রেনগুলো চলাচল করে সেগুলো দেখেন, তাহলেই প্রাথমিক ধারণা লাভ করতে পারবেন। ট্রেনের বগিগুলো জরাজীর্ণ। লোকাল ট্রেনের আসনগুলোর এমন জীর্ণশীর্ণ দশা যে ট্রেনে উঠেও সেখানে বসতে ইচ্ছা করবে না। অনেক যাত্রী বসার বদলে দাঁড়িয়েই যান।
আরো একটু ধারণা নিতে চাইলে রেলস্টেশনগুলো পরিদর্শন করা যেতে পারে। সেগুলোর করুণ পরিণতি। স্টেশনগুলোর কোনো পরিচর্যা নেওয়া হয় না। সর্বোচ্চ যতখানি অবহেলা প্রদর্শন করা যায়, স্টেশনগুলোর প্রতি সেই অবহেলা করা হয়েছে।
রংপুরের রেলের প্রতি কেন এত অবহেলা, তার কোনো সদুত্তর মেলে না। রংপুরের সাধারণ মানুষ কি রেলবিমুখ হয়েছে? রেল ভ্রমণে কি সময় বেশি প্রয়োজন হয়, বেশি টাকা লাগে? সরকার কি রেল পরিচালনা করলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়? এগুলোর কোনোটাই ঠিক নয়। রংপুরের রেলের প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ থাকার পরও সরকার এত বৈরী মনোভাবাপন্ন কেন? এই বৈরিতা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল আগেও। রংপুর থেকে তখন ‘একতা’ ও ‘তিস্তা’ নামে দুটি ট্রেন রংপুর থেকে ঢাকা যেত। কোনো কারণ ছাড়াই এই ট্রেন দুটি তারা বন্ধ করে দেয়। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রংপুরবাসীর পক্ষে এই ট্রেন দুটি চালুর জন্য জোরালো আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের সময়ে সরকার রংপুর এক্সপ্রেস নামে একটি আন্তনগর ঢাকা-রংপুর ট্রেন চালু করে। একটি নতুন নামে ট্রেন চালু করলেও ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে শুরু করে সব বগিই অনেক পুরাতন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিটি কয়েক দিন চললে আবার কয়েক দিন বন্ধ থাকে। প্রথম শ্রেণির বগিগুলোতে প্রথম শ্রেণির সুবিধা নেই বললেই চলে।
দেশের সাধারণ জনগণ, আমলা, রাজনীতিক, মন্ত্রী-সাংসদ সবাই জানেন, রংপুর অঞ্চল দেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এও জানেন, তাঁদের উন্নয়নের কথা বলার জন্য বিশেষ ক্ষমতাধর কেউ নেই। তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, রংপুর অঞ্চলের রেল সুবিধা দেওয়া গেলে তাঁরা কিছুটা হলেও এগিয়ে যাবেন। তার পরও এই কাজ কোনো সময়েই হচ্ছে না। আমরা জানি, বাংলাদেশে রাজনীতির অনুশীলন হচ্ছে ‘দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়।’ সে কারণে দেশের উন্নয়নে সমতা বিধানের চেষ্টা কারো মধ্যেই নেই। অথচ আমাদের সংবিধানে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে, তুলনামূলক পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা।
মহাজোট সরকার রেলের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়ার লক্ষ্যে রেল মন্ত্রণালয় চালু করেছে। রেল স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হওয়ার পর বাংলাদেশের রেল বিভাগে বিশেষ গতিরও সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু সেই গতিবেগ রংপুর পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি।
রংপুরে দিবাকালীন আন্তনগর ট্রেন, চলমান ট্রেনগুলোয় নতুন আধুনিক বগি সংযোজন এবং বন্ধ ট্রেন চালু করার দাবিতে বর্তমানে আন্দোলন করছে রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদ। গত ১৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী বরাবর তারা একটি স্মারকলিপিও দিয়েছে। স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেছে, ‘এ অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু রংপুরে যাতায়াতের জন্য চালু থাকা ট্রেনগুলোর মধ্যে সাতটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রংপুর রেলস্টেশন লাভজনক হলেও এই পথে দীর্ঘদিন চলা ট্রেনগুলো অকারণেই বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি আন্তনগর ট্রেনের দাবিতে কুড়িগ্রামের রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি আন্দোলন করছে। কুড়িগ্রাম-উলিপুর-চিলমারী-রাজারহাটসহ ওই রুটের সব এলাকায় গেলেই চোখে পড়বে ‘ঢাকা-রংপুর ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস চাই’ শীর্ষক দেয়াল লিখন। রংপুর কিংবা কুড়িগ্রামের রেলের জন্য যে আন্দোলন হচ্ছে, এটি নেহাত কোনো আবেগের বিষয় নয়। এই আন্দোলনের বস্তুনিষ্ঠতা এতটাই শক্ত যে অনতিবিলম্বে এসব অঞ্চলে রেলের দাবি পূরণ করা প্রয়োজন। দেশে চলছে রেল সম্প্রসারণের কাজ আর রংপুরে চলবে রেল সংকোচনের কাজ, একই দেশে স্ববিরোধী এই নীতি কেন? কয়েক দিন আগে রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি কুড়িগ্রামে ট্রেন অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। আন্দোলনকারীদের অবরোধে প্রচুর সংখ্যক সাধারণ মানুষও যুক্ত হয়েছিল।
আন্দোলন ছাড়া রংপুরের মানুষের উন্নয়নের আর কোনো পথ খোলা নেই। সংসদে গিয়ে যাঁদের নিজ এলাকার কথা বলার কথা, তাঁরা সেই কাজ করেন না। অধিকাংশই ব্যস্ত থাকেন নিজ নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। তাঁদের নিজেদের বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। তাঁদের পক্ষে এলাকার সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করা অসম্ভব প্রায়। সরকারও দেশের সুষম উন্নয়নের পক্ষে নয়। যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প এলেই ক্ষমতাসীন উচ্চপদস্থরা এলাকাভিত্তিক বরাদ্দ নিয়ে নেন। প্রভাবক উচ্চপদস্থ কেউ এ এলাকায় না থাকার কারণে এসব এলকায় উন্নয়নের ঢেউ লাগে খুব সামান্য মাত্রায়, যেটুকু না হলে নয় সেটুকু।
রংপুর থেকে ঢাকার রেল যোগাযোগ পরিকল্পিতভাবে করতে পারলে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ওপর চাপ অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। সড়কপথের দুর্ঘটনার হারও অনেক কমে আসবে। রংপুর রেলের সামগ্রিক উন্নয়ন হয়তো অনেক দূরের ব্যাপার। তার পরও কিছু কিছু সুবিধা সৃষ্টি করা খুবই সহজ। এ মুহূর্তে একটি দিবাকালীন ঢাকা-রংপুর আন্তনগর এবং কুড়িগ্রাম-ঢাকা আন্তনগর ট্রেন চালু করা সরকারের পক্ষে খুবই সহজ। কয়েক মাস আগে কুড়িগ্রামের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের রেল যোগাযোগ সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্যের পর আর নতুন কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। রংপুরের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের উন্নয়ন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটলেই উন্নয়ন বৈষম্য দূর হবে।
সরকার রেলের নতুন নতুন পথ নির্মাণ করছে। সেটা দেশের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই সেখানে রেলপথেরও উদ্বোধন হবে। সরকারের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার মতোই। সেই সঙ্গে যে রেলপথগুলো চরম মাত্রায় অবহেলার শিকার, সেগুলোর অবহেলার কারণ ঝেড়ে ফেলতে হবে।
সরকার এ বছর ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ট্রেনের ২৭০টি বগি নতুন ক্রয় করছে। এই বগিগুলোর সুষম বণ্টন হলে রংপুর-কুড়িগ্রাম থেকে আলাদা আলাদা করে দুটি আন্তনগর এক্সপ্রেস পেতেই পারে। এই পাওয়া নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। তবে রংপুর ও কুড়িগ্রামে দুটি আন্তনগর ট্রেন এই অঞ্চলের মানুষ পাওয়ার অধিকার রাখে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।