দৃষ্টিপাত
লামায় প্রাণে বাঁচল আড়াইশ কুকুর
স্থানটি ঢাকা থেকে অনেক দূরে সেই বান্দরবান জেলার লামা উপজেলা। হঠাৎ করেই লামার উপজেলা পরিষদের মেয়র সিদ্ধান্ত দিলেন সেখানকার সব কুকুর মেরে ফেলা হবে। অপরাধ একটাই, আর তা হলো একটি কুকুর না বুঝে একজনকে কামড়ে দিয়েছে আর তার অপরাধে সব কুকুরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে।
সবাই এ সিদ্ধান্তে খুশি হলেও এখনো এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের মনে প্রকৃতির এই বোবা নিষ্পাপ প্রাণীগুলোর প্রতি মমতা কাজ করে। তেমনি একজন হলেন সৈয়দ শান্ত।
তিনি সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠানের অডিটের কাজে লামা গিয়েছিলেন। এমন বর্বর ঘোষণায় তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। চাকরির সুবাদে নতুন জায়গায় আসা, কাউকে চেনেনও না ভালোমতো কিন্তু সাহস করে একাই এগিয়ে গেলেন অসহায় প্রাণীগুলোর জীবন বাঁচাতে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দেখা করলেন মেয়রের সঙ্গে। কিন্তু মেয়র ততক্ষণে মাইক দিয়ে পুরো উপজেলায় প্রচার করে দিয়েছেন, যেখানে যত কুকুর দেখা যায় সব যেন মেরে ফেলা হয়।
মেয়রকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন শান্ত, একটা কুকুর মানুষকে কামড়েছে বলে সব কুকুর মেরে ফেলাটা অন্যায়। কিন্তু তাতে মেয়র রাজি না হওয়াতে তিনি গেলেন লামার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। এখানেও তাঁকে নিরাশ হতে হয়। শান্ত জানতেন, বাংলাদেশে কুকুর মারার বিষয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কাগজপত্র মেয়রকে দেখান।
সবকিছু মিলিয়ে শান্ত মেয়রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ভয় দেখালেন। এবারে কিছুটা কাজ হলো, মেয়র তাঁর কুকুর মারার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ালেন। সৈয়দ শান্ত নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেয়রকে দিয়ে পুনরায় মাইকিং করালেন যেন কোনো কুকুরকে না মারা হয়।
সৈয়দ শান্তর একক সাহসী প্রচেষ্টার ফলে প্রাণে বেঁচে গেল এতগুলো অসহায় প্রাণী। কিন্তু তাদের নিশ্চিতভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হলে জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া প্রয়োজন। এবারে তিনি শরণাপন্ন হলেন ঢাকার ‘কেয়ার ফর প’জ’ এবং চট্টগ্রামের ‘রাইজ ফর প’জ’ নামক প্রাণী প্রেমীদের সংগঠনের। এই সংগঠন দুটোই অসহায় নির্যাতিত রাস্তায় পড়ে থাকা কুকুর-বিড়ালগুলোর শুশ্রূষা প্রদান এবং অধিকার নিয়ে কাজ করে থাকে।
এবারে শুরু হলো প্রায় আড়াইশ অসহায় কুকুরকে প্রতিষেধক দেওয়ার জন্য অর্থ ও টিকা সংগ্রহ করার যুদ্ধ। লামা উপজেলা প্রশাসন কোনো সহযোগিতা করতে না চাইলেও থেমে থাকেননি প্রাণীপ্রেমী ওই সংগঠন দুটির সদস্যরা।
ফারজানা নীলা, তৃষা, এমিলসহ আরো অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে অসহায় প্রাণীগুলোকে বাঁচানোর জন্য প্রচারণা চালাতে থাকেন। সেই সাথে অর্থ সাহায্যও চাইতে থাকেন। প্রায় আড়াইশ কুকুরকে টিকা দিতে প্রয়োজন কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা।
অনেকেই তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, এভাবে জোগাড় হলো প্রায় ২০ হাজার টাকা। বাকি টাকাটা সংগঠনের সদস্যরা ধার করে প্রয়োজনীয় টিকা ও গলার বেল্ট নিয়ে ১৩ জনের একটি দল গত পয়লা মে চলে গেল বান্দরবানের লামায়।
এই দলে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, চাকরিজীবীসহ সবাই। তাঁরা প্রথমেই উপজেলা মেয়রকে নিয়ে একটি জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করলেন যেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা সাধারণ মানুষকে কুকুরকে ভয় না পাওয়ার বিষয়ে উপদেশ দিলেন, সেই সাথে কুকুর যে প্রাচীন কাল থেকে মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধু তাও বোঝানো হলো।
তারপর শুরু হলো আসল কাজ, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কুকুর ধরা আর টিকা দেওয়া। কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। কুকুরগুলো অপরিচিত মানুষগুলোকে ভয় পাচ্ছিল, তাই কাছে ভিড়ছিল না। পুরো টিমে ভেটেরিনারি ডাক্তার ছিলেন মাত্র একজন।
দলের বাকি সদস্যরা বিস্কুট কখনো বা পাউরুটির লোভ দেখিয়ে কুকুরগুলোকে কাছে ডাকছিল। কাছে আসা মাত্রই তাদের আদর করে চেপে ধরে ইঞ্জেকশনের সুচ ফুটিয়ে টিকা দিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এলাকার মানুষও তাদের অনেক সহায়তা করছিল।
স্থানীয় মানুষজন অনেক কুকুর ধরে এনে প্রতিষেধক টিকা দিয়ে নিচ্ছিল। অনেক দুষ্টু কুকুরকে স্বাভাবিকভাবে ধরতে না পেরে জাল দিয়ে আটকে টিকা দেওয়া হচ্ছিল। এভাবে সারাদিন ধরে কুকুরের টিকা দেওয়া অভিযানে আসা শান্ত, সবুজ, তৃষা, নাভিদ, রবিউল, অভ্র, নওশের, মেহজাবিন, প্রমি, নাদিয়ারা কখনো আদর করে, কখনো জালে পেঁচিয়ে, কখনো বা চেপে ধরে ২২০টি কুকুরকে টিকা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করল। সবচেয়ে বড় কথা তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে এতগুলো নিষ্পাপ প্রাণীর জীবন তো বাঁচলোই, সেই সাথে যোগ হলো কুকুর বিষয়ে জনসচেতনতা।
স্থানীয় কিছু মানুষ বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখলেও বেশির ভাগ মানুষই অসহায় প্রাণীর প্রতি তাদের এই যুদ্ধকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কুকুরগুলোকে বাঁচাতে যিনি প্রধান যুদ্ধটি করেছিলেন সেই সৈয়দ শান্ত জানালেন, ‘ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের ভালোবাসি, মানুষই হোক আর কুকুর হোক প্রাণ তো। অকারণে একটা প্রাণ কেন মারবে? তাই মনের তাগিদে বাধা দিয়েছি এতগুলো বোবা অসহায় প্রাণীর জীবন বাঁচাতে।’
চট্টগ্রাম থেকে ছুটে আসা তৃষা জানালেন, ‘আমরা যখন নিপীড়িত অসহায় পথ প্রাণীগুলোর উপকার করি তখন মনের মাঝে যে শান্তি ও নির্মল ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে তার কোনো তুলনা হয় না। এই অতুলনীয় ভালো লাগার জন্য আমরা বিড়াল-কুকুরের পেছনে ছুটি। তাদের একটু খাবার দেই, একটু আদর করি। বিশ্বাস না হলে একটি ক্ষুধার্ত কুকুরকে এক টুকরো রুটি ছুড়ে দিয়ে দেখুন সে যে তৃপ্তি নিয়ে খাবে এবং খাওয়ার পর আপনার দিকে যে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাবে, সেই দৃষ্টি দেখে আপনার বুক ভরে যাবে যদি আপনি মানুষ হয়ে থাকেন।’
মানুষ অসহায় হলেও তার অধিকারের কথা মুখ ফুটে বলতে পারে কিন্তু বোবা অসহায় প্রাণীগুলো নিজেদের অধিকারের কথা বলতে পারে না, তাই ‘কেয়ার ফর প’জ’ ও ‘রাইজ ফর প’জ’ সংগঠন দুটি এসব অসহায় প্রাণীর অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমরা যতই প্রযুক্তির উন্নতি করি না কেন আমরা প্রকৃতির সন্তান, কাজেই প্রকৃতির প্রতি অন্যায় করে, অবাধে গাছপালা কেটে, অসহায় প্রাণীদের কষ্ট দিয়ে আমরা কখনোই আমাদের উন্নয়ন ধরে রাখতে পারব না। প্রকৃতি ঠিকই তার প্রতি সব অন্যায়ের শোধ নেবে। তাই, এখনই আমাদের প্রকৃতির প্রতি, তার প্রাণীকূলের প্রতি সদয় হওয়া দরকার। আর একটু সাহস করে দাঁড়ালেই যে অনেক অসাধ্য সাধন করা যায় তার নিদর্শন দেখালেন সৈয়দ শান্ত।
শান্তর মতো এমন সাহসিকতা নিয়ে সব কাজে আমরা এগিয়ে এলেই তো আমাদের দেশটা একটা সুন্দর দেশ হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : পুরাতত্ত্ববিদ