সতর্কতা
বজ্রপাত ও আমাদের করণীয়
দেশের সব ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ১২, ১৩ ও ১৪ মে ২০১৬ তারিখের একটি ভয়াবহ খবর হলো- ১২ ও ১৩ মে তারিখে আগের দিন ৫১ জন, পরেরদিন ১৭ জন নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মোট ৬৮ জন লোক বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেছে। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে আরো কমপক্ষে অর্ধশতাধিক।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়িতে দুজন, পাবনায় ছয়জন, কিশোরগঞ্জে চারজন, রাজশাহীতে পাঁচজন, নরসিংদীতে চারজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চারজন, নাটোরে চারজন, নারায়ণগঞ্জে একজন, দিনাজপুরে একজন, হবিগঞ্জে একজন, নেত্রকোনায় দুজন, পিরোজপুরে একজন, গাজীপুরে দুজন, নওগাঁয় তিনজন, সিরাজগঞ্জে পাঁচজন, রাজবাড়িতে পাঁচজন, গাইবান্ধায় দুজন, টাঙ্গাইলে দুজন, সুনামগঞ্জে দুজন, নড়াইলে দুজন, জয়পুরহাট তিনজন, যশোরে দুজন ও মাগুরায় একজসসহ মোট ৬৮ জন নিহত হয়েছে।
১২ ও ১৩ মে তারিখ দুপুর থেকে শুরু করে রাত ৯টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এসব আহত-নিহতের ঘটনা ঘটেছে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, কর্মজীবী, শিশু, নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, মধ্যবয়সী, বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিতসহ সব ধরনের শ্রেণি-পেশার মানুষই রয়েছে এসব মৃত্যুর মিছিলে। স্মরণকালে একদিনে বা দুইদিনে এত পরিমাণ মানুষ বজ্রপাতে মারা যেতে শোনা যায়নি। এটি নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক ও বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এ দুর্ঘটনা এখন রীতিমতো একটি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। টেলিভিশনের স্ক্রলে, অনলাইন সংবাদপত্রের আপডেটে এবং দৈনিক পত্রিকার পাতায় এখন চোখ রাখতে ভয় করছে যে, আবার কতজনের মৃত্যুর খবর পড়তে, শুনতে ও দেখতে হবে! এখন জানা দরকার কীভাবে হয় এসব বজ্রপাত। আবার কীভাবেই বা এ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। প্রতি বর্ষা মৌসুমেই দেশে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, গতবছর (২০১৫) মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাত মাসে দেশে বজ্রপাতে ১৮০ জনের প্রাণহানি হয়েছিল।
গবেষকরা বলেছেন, বিশ্বজুড়ে বছরে প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ বার বজ্রপাত সংঘটিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাচ্ছে, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে প্রতি মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৪০ বার বজ্রপাত হয়। বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত বলেই বাংলাদেশকে বজ্রপাত প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নতুন নতুন গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, বিশ্বে যে হারে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বজ্রপাতের হার বাড়বে বর্তমানের তুলনায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। বৃষ্টিপাতের তীব্রতা ও মেঘের প্লাবতা পরিমাপের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালেফোর্নিয়ার জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এ অবস্থায় বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পেলে মানুষের হতাহত হওয়ার ঝুঁকি তো বাড়বেই, পাশাপাশি শুষ্ক বনাঞ্চলে দাবানলের আশঙ্কা আরো বাড়বে। তখন সেখানে শুধু মানুষ নয় পাখিসহ বিলুপ্তপ্রায় নানারকম প্রাণির প্রজাতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে আমাদের ঝুঁকি ও শঙ্কা সঙ্গত কারণেই বেশি।এ দেশে এমনিতেই আমরা বেশ কিছু প্রাকিৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি মোকাবিলা করতেই হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপর প্রাক-বর্ষা মৌসুমে এ বজ্রপাত আতঙ্ক আবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ঋতু পরিক্রমায় বর্ষাকালেই সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে থাকে। এলাকাভেদে গ্রামীণ পরিভাষায় এ বজ্রপাতকে ‘বাজ’ কিংবা ‘ঠাডা’ বলা হয়ে থাকে। বর্ষাকালের মধ্যে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ- এ দুই মাস সবচেয়ে বেশি বাজ পড়তে দেখা যায়। আকাশ যখন ঘনকালো অন্ধকার হয়ে চারিদিকে মেঘ ঢাকঢাক গুড়গুড় করতে দেখা যায় এবং বায়ুমণ্ডলে ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি এমনকি ঊর্ধ্বাকাশে বায়ু চলাচল কম থাকলে, একটি গুমট আবহাওয়া সৃষ্টি হলে, সেখানে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়।
আকাশে থাকা চলন্ত মেঘ রাশিমালা যখন এদিকে ওদিকে চলাচল করতে থাকে একটির সাথে আরেকটি ধাক্কা বা ঘর্ষণ খেতে থাকে। এভাবে পাশাপাশি দুই বা তার অধিক মেঘের ধাক্কা খাওয়ার ঘর্ষণের ফলে সেই স্থানে বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। সেই বিদ্যুতের জন্যই আমরা আকাশে তাৎক্ষণিক আলো জ্বলতে দেখি। তখন সেটার দূরত্বের ওপর নির্ভর করে শব্দটা তখন আমাদের কানে চলে আসে। কাছে হলে শব্দ আগে এবং দূরে হলে শব্দ অপেক্ষাকৃত বেশি সময় পরে শোনা যায়। কারণ আমরা জানি শব্দের গতির চেয়ে আলোর গতি অনেক বেশি, সেজন্য আলো দেখার অনেক পর আমরা এর শব্দ শুনতে পাই। যেসব বজ্রপাতের সময় দেখা যাবে যে, বজ্রপাত হওয়ার সাথে সাথেই শব্দও চলে আসছে, তখন বুঝতে হবে বজ্রপাত খুব কাছের কোনো স্থানে হচ্ছে। সেজন্য সবাইকে তখনি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এটিও একটি নিয়ন্ত্রণহীন দুর্যোগ। কাজেই এ থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ পাওয়া হয়তো কখনোই সম্ভব নয়। তারপরও কিছু বৈজ্ঞিানিক সতর্কতামূলক পন্থা রয়েছে। যেগুলো অনুসরণ করলে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
(১) বর্ণিত গুমট আবহাওয়ার দিনে পারতপক্ষে বাড়িঘর থেকে বের না হওয়া, কারণ ঘরের ভিতরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে- এমন উদাহরণ খুবই কম (২) প্রত্যেকের বাড়িঘর বৈজ্ঞানিক উপায়ে বজ্রপাত প্রতিরোধী হিসেবে তৈরি করা। দুইভাবে বাড়িঘরকে বজ্রপাত প্রতিরোধী করা যেতে পারে। ক. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিশেষ করে- ইস্ত্রি, ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, এসি, মোবাইল সেট, ওভেনসহ ঘরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে সুরক্ষাকরণের জন্য ইলেক্ট্রিকেল আর্থিং করা খ. সুউচ্চ গগনচুম্বী দালানকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য পুরো দালানকে আর্থিং করা (৩) খোলা আকাশের নিচে যেকোনো উঁচু জিনিসের প্রতি বজ্রবিদ্যুতের চার্জ ডিসচার্জ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেখানে লম্বা গাছ (তাল, সুপারি), বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খাম্বা/খুঁটি, মোবাইল টাওয়ারসহ যেকোনো ধরনের ধাতব এমনকি বিদ্যুৎ অপরিবাহী/কুপরিবাহী জিনিসই বজ্রের বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে। সেজন্য বজ্রপাতের সময় এগুলোর নিচে থাকা যাবেন না (৪) খোলা আকাশের নিচে কিংবা খোলা মাঠে বজ্রপাতের সময় লম্বা শিক/লাঠিযুক্ত ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটা যাবে না, তাহলে ছাতার মাধ্যমে চার্জিত হতে পারে। (৫) খোলা আকাশের নিচে থাকলে বজ্রপাতের সময় সম্ভব হলে কোনো আশপাশের ঘরে আশ্রয় নিতে হবে, না পারলে মাটিতে তাৎক্ষণিক শুয়ে পড়তে হবে। (৬) নৌকার মধ্যে থাকলে এর লম্বা ছই বা মাস্তুল থেকে দূরে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
বজ্রপাতের বিদ্যুৎ থেকে প্রায় ১০ হাজার এম্পিয়ার বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় এবং তা থেকে ৫০ হাজার কেলভিন তাপশক্তি রিলিজ হয় মাত্র শতভাগের একভাগ মিলি সেকেন্ড সময়ের মধ্যে। সেজন্যই বজ্রপাতে নিমিষেই বুঝে উঠার আগেই মানুষের শরীর পোড়ে ঝাঁঝড়া হয়ে যায়। যেসব স্থানে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে দেখা গেছে যে, এগুলোর বেশির ভাগই নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। সেজন্য সরকারের তরফে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় হতে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আহতদের সুচিকিৎসা এবং নিহতের পরিবারের পাশে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে এগিয়ে যেতে হবে অতি দ্রুত।
এটিকে একটি দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে এখন। কাজেই একে দুর্যোগ মেনে নিয়ে তদানুযায়ী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ হতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে এবং সর্বোপরি অন্যান্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এ বর্ষা মৌসুমে উপরোক্ত সতর্কতাগুলো একটু গুরুত্বের সাথে মেনে চলতে চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়