দৃষ্টিপাত
নিঃসঙ্গ এক সেতার বাদক অধ্যাপক রেজাউল
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুন হওয়ার এক মাস পূর্ণ হলো। তাঁর দুই সন্তান রিজওয়ানা হাসিন ও রিয়াসাত ইমতিয়াজ বারবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বাবার খুনিদের ধরার কোনো অগ্রগতি তাঁদের চোখে পড়েনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ করে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করা রিজওয়ানা আর রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ বর্ষের ছাত্র রিয়াসাত ইমতিয়াজের মুখোমুখি হয়েছিলাম খুনের ষষ্ঠ দিন। রাজশাহী শহরে তাঁদের শালবাগানের বাসায়। সন্ধ্যায়।
মাত্রই দোয়া মাহফিল শেষ হয়েছিল। অনেক কথার মাঝে, মেয়ে রিজওয়ানা যে কথাটি জোর দিয়ে বলতে চাইলেন, ‘বাবার হয়তো নিজস্ব কিছু বিশ্বাস ছিল। কিন্তু তাই বলে এভাবে বাবাকে খুন করতে হবে? দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এই হত্যার কারণ!’
ভবানীপুর পৌরসভার দরগামারিয়া গ্রাম, রাজশাহী থেকে দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটারের। আর সব ছায়াসুনিবিড় গ্রামের মতোই দরগামারিয়া। এই গ্রামেরই সন্তান শিক্ষক রেজাউল করিম। গ্রামটিতে যখন আমরা পৌঁছালাম, তখন সকাল গড়িয়েছে। শুক্রবার। জুমা বার। সবার মধ্যেই হয় তো একটা শঙ্কা কাজ করছিল। গেল শুক্রবারেও স্বাভাবিক ছিল দরগামারিয়া। সপ্তাহ ঘুরতেই গ্রামে ভর করেছে চাপা আতঙ্ক।
দরগামারিয়া আহলে হাদিস জামে মসজিদ। এই মসজিদের সংস্কারকাজে কিছুদিন আগেও অর্থ সহায়তা দিয়েছেন রেজাউল করিম। পাশেই মাদ্রাসা। রেজাউল করিমের পরিবার বরাবরই অর্থ দিয়েছে এই মাদ্রাসাতেও। খুন হওয়ার পর জড়িত সন্দেহে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় মসজিদের ইমাম রায়হান আলীকে। দেড় বছর ধরে এই গ্রামে বাস করছেন রায়হান। বিয়ে করেছেন গ্রামেরই ইয়াদ আলীর কন্যাকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মাদ্রাসায় পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের তিনি নিষেধ করতেন, রেজাউল করিম প্রতিষ্ঠিত দরগামারিয়া সংগীত বিদ্যালয়ে গান শিখতে যেতে।
মসজিদের সামনেই কথা হলো ইমামের শ্বশুর ইয়াদ আলীর সঙ্গে। স্বীকার করলেন, রায়হান শিশুদের গানের স্কুলে না যেতে বলতেন। তবে তাতে জেদাজেদি ছিল না।
মসজিদে নামাজের আয়োজন চলছে। এর মাঝেই আমাদের ঘিরে ধরল বেশ কয়েকজন নারী-শিশু। তাদের একটাই দাবি ইমাম রায়হান আলীকে মুক্তি দেওয়া হোক। রায়হান আলী ছাড়া মাদ্রাসা চলবে না। ‘ছেলেপেলেরা’ পড়তে পারবে না। মসজিদে নামাজ হবে না। এর মাঝেই মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল খুতবার ধ্বনি। পড়ছিলেন খুন হওয়া শিক্ষক রেজাউল করিমের বাবা, এক সময়কার ডাকসাইটে শিক্ষা কর্মকর্তা, আবুল কাশেম।
দীর্ঘদিন এই গ্রামের অভিভাবকের মতোই আছে এই পরিবার। অথচ রেজাউল করিম হত্যার বিচারের দাবি শোনা গেল না সেসব গ্রামবাসীর কাছে, যারা ইমামের মুক্তি কামনা করছিল। কেমন ছিলেন রেজাউল করিম? জানতে চাইলে, এক কথায় উত্তর, ‘ভালো লোক ছিলেন।’ এর বেশি কিছু না। খটকা লাগল, দেড় বছর অবস্থান করেই গ্রামবাসীর মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন ইমাম রায়হান আলী। অথচ গ্রামের সুখ-দুঃখের সাথী, গ্রামেরই সন্তান রেজাউল করিমের খুনের বিচার চাইছে না কেউ!
নামাজ শেষে কথা হলো শিক্ষক রেজাউল করিমের বাবা, আবুল কাশেমের সাথে। কথায় কথায় বললেন, ‘কত লোকই তো ছেলেকে বেনামাজি বলেছে। বলেছে, বেনামাজি ছেলের ঘরে ভাত খাও কেন? আমি বলেছিলাম, রাজশাহী শহরে আমার দুই ছেলে থাকে। রেজাউল নামাজ পড়ে না, আমি তার ঘরে ভাত খাই না। আমার আরেক ছেলেও রাজশাহীতে থাকে। সে নামাজি। তার ঘরেই রাজশাহী গেলে আমি ভাত খাই।’
বুঝলাম, রেজাউল করিম নামাজ পড়তেন না। আর মনে মনে ভাবলাম, পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে একটা পরিবারের কর্তা এই ভাবে প্রকাশ করতে পারেন নিজের অসহায়ত্ব। অথচ শিক্ষাদীক্ষায় এই পরিবারই গ্রামে সবার চেয়ে এগিয়ে।
মসজিদ থেকে প্রায় ২০০ ফুট দূরে রেজাউল করিমের বাড়ি। পাশেই নিজস্ব জমিতে চার চালা ঘর। এখানেই আগের শুক্রবার বিকেলেও গান গেয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। দেড় বছর আগে গ্রামে এই গানের স্কুল গড়ে তোলেন শিক্ষক রেজাউল। গান শেখাতে দুই গ্রাম দূরের গানের শিক্ষক ইব্রাহিম আলী সরকারকে নিযুক্ত করেছেন। শুরুতে আট-দশজন শিক্ষার্থী পেলেও, পরে কমে তিনজনে নেমে আসে। কারণ একটাই, মাদ্রাসার শিক্ষক রায়হান আলী নিষেধ করেছেন শিশুদের গানের স্কুলে না যেতে। কি করা যায়? গানের শিক্ষক ইব্রাহীম আলীকে নিয়ে এবার পাশের গ্রাম থেকে শিক্ষার্থী জোগাড় করলেন রেজাউল করিম। গেল শুক্রবার, তারাই এখানে শিক্ষকের কাছে গানের তালিম নিয়েছে।
আর আজ ফাঁকা সেই সংগীত বিদ্যালয়। আতঙ্কে সিটিয়ে আছেন ইব্রাহীম আলী। আশঙ্কা, স্কুলটা আর চলবে না। আশপাশের দশগ্রামে আর কোনো গানের স্কুল নেই। গ্রামের আশি শতাংশ শিশুই স্কুলে যায় না। এখানেই প্রগতিশীলতার বাতায়ন খুলেছিলেন শিক্ষক রেজাউল!
গ্রামবাসীর সাথে আলাপেই বেরিয়ে এলো, গ্রামে এলেই ঘুরে ঘুরে এখানাকার বিভিন্ন উপকথা সংগ্রহ করতেন অধ্যাপক রেজাউল। ঘুড়ি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। নিজের অর্থেই। এবারের ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছিলেন তিনি।
শিক্ষার আলো সেভাবে পৌঁছায়নি যে গ্রামটিতে সেখানে আলো ছড়াতে চেয়েছিলেন রেজাউল করিম। এ গ্রামের মানুষ ধর্মভীরু। সেই ভীরুতাকে পুঁজি করে এখানেই বেড়ে উঠেছিল বাংলা ভাই। ত্রাসের সেই রাজত্বে আজো বন্দি আছে ধর্মান্ধরা। সেখানে কি একা একজন অধ্যাপক রেজাউল করিম লড়াই করতে পারেন? এই প্রশ্নটাই ঘুরে ফিরে জানান দিচ্ছিল, তবে কি এই প্রগতিশীলতাকেই ভয় করত কোনো গোষ্ঠী? এ কারণেই কি খুন হলেন রেজাউল করিম?
তার দুই সন্তান আগের সন্ধ্যায় জানিয়েছিলেন, বাবার নিজস্ব কিছু বিশ্বাস আছে। গানের স্কুল, সেতার বাদন, নামাজ না পড়া, গ্রামে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালানো-এসবই কি তাঁকে করে তুলেছিল কারো প্রতিপক্ষ?
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী