অভিমত
ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসের সিগন্যালিং ব্যাপক প্রচার হওয়া উচিত
বছরের বিভিন্ন সময়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল আবহাওয়ার দরুন বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় সামুদ্রিক ঝড়ের আঘাত আসে। প্রলয়ঙ্করীরূপে সেসব ঝড়ের কবলে পড়ে বিনষ্ট হয় অনেক সম্পদ, প্রাণহানি হয় অনেক মানুষের। স্মরণাতীতকালের মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে করা যেতে পারে। সেই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে উপকূলীয় সব জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল সেদিন। তারপর আইলা, সিডর, নার্গিস এবং সর্বশেষ রোয়ানুর কথা আমরা সবাই জানি। এগুলোর মাধ্যমে যেমন নষ্ট হয়েছে সম্পদ, তেমনি গেছে মানুষের প্রাণও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের বিশ্ব-ঐতিহ্য ও একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। তবে আগের তুলনায় এখন আবহাওয়া বিভাগ আরো বেশি তৎপর ও পূর্বাভাস প্রদানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে অনেক আগে থেকে তা জানা যাচ্ছে।
সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পূর্বাভাস ও সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ক্ষয়ক্ষতি আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে যে প্রচলিত ধারায় ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস সম্পর্কিত সতর্কতামূলক সিগন্যালিং ব্যবস্থা মিডিয়ায় প্রচার করা হয়ে থাকে, তা মোটেও সাধারণ নাগরিকদের জন্য সহজবোধ্য নয়। সেটিকে যদি আরো বিশ্লেষণধর্মী, সুনির্দিষ্ট উপদ্রুত এলাকায় এবং অন্য সব এলাকার সর্বসাধারণের জন্য বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করা যায়, তবে ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক কমে যেতে বাধ্য। তা ছাড়া এখন এগুলোর সারমর্ম ভালোভাবে আয়ত্ত করতে না পারার কারণে সিগন্যাল ও সতর্কবার্তা আগেভাগে পেলেও তাতে মানুষের রেসপন্স কম পেতে দেখা গেছে। দেখা গেছে, ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত পেয়েও মানুষ তার নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাইছে না। এখন সমুদ্রবন্দরের জন্য যত সংকেত এবং সেগুলো নিয়ে আলোকপাত করব। উপকূলে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঝড়ের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন সতর্কতা সংকেত জারি করে থাকে। ঝড়ের গতি ও বিপদের সম্ভাব্য মাত্রা বিবেচনায় ১ থেকে ১১ নম্বর পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে উপস্থাপিত সংকেতগুলো ব্যাখ্যা করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ ছাড়া বাতাসের গতিবেগের ওপর ভিত্তি করে বায়ুচাপ ও ঝড়ের শ্রেণিবিন্যাস করেছে তারা।
সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটারের (কিমি) অধিক হলে সেটিকে ঘূর্ণিঝড় বলছে অধিদপ্তর। বাতাসের গতিবেগ ১৭-৩০ কিমি হলে লঘুচাপ, ৩১-৪০ কিমি হলে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, ৪১-৫০ কিমি নিম্নচাপ, ৫১-৬১ কিমি গভীর নিম্নচাপ, ৬২-৮৮ কিমি ঘূর্ণিঝড়, ৮৯-১১৭ কিমি তীব্র ঘূর্ণিঝড়, ১১৮-২১৯ কিমি হারিকেন এবং বাতাসের গতিবেগ ২২০ কিমি বা তার বেশি হলে তা হবে সুপার সাইক্লোন। সমুদ্রবন্দরের জন্য সংকেতগুলো—(১) ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত : বঙ্গোপসাগরে দূরবর্তী এলাকায় একটি ঝড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে। সেখানে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার, যা পরিণত হতে পারে সামুদ্রিক ঝড়ে; (২) ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত : দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ৬২-৮৮ কিমি। বন্দর এখনই ঝড়ে কবলিত হবে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ বিপদে পড়তে পারে; (৩) ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত : বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলো দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ হতে পারে ৪০-৫০ কিমি; (৪) ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত : বন্দর ঘূর্ণিঝড়কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ৫১-৬১ কিমি। তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি নেওয়ার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় এখনো আসেনি; (৫) ৫ ও ৬ নম্বর বিপদ সংকেত : ঝড়ো বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে; (৬) ৭ নম্বর বিপদ সংকেত : ঝড়ো বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরের ওপর বা কাছ দিয়ে অতিক্রম করতে পারে; (৭) ৫, ৬ ও ৭ নম্বর সংকেত একই মাত্রার। এখানে শুধু পার্থক্য হলো ঝড় কোন দিক দিয়ে যাবে তার ওপর; (৮) ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত : বন্দর সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তার বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি উপকূলকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে; (৯) ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত : বন্দর সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তার বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি উপকূলকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে; (১০) ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত : বন্দর সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তার ঊর্ধ্বে হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরের ওপর বা কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। তেমনিভাবে ৮, ৯ ও ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের মাত্রাও প্রায় একই রকম; (১১) ১১ নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সংকেত : আবহাওয়া বিপদ সংকেত প্রদানকারী কেন্দ্রের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ব্রিটিশ শাসনামলে এবং বাংলাদেশের শাসনামলে তৈরি পর্যায়ক্রমিক এই সংকেত ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক সংকেত ব্যবস্থা থেকে একটু ভিন্ন। তার পরও যুগোপযোগী হওয়ার কারণে এসব সংকেতের অর্থ জানা থাকলে সতর্কতা অবলম্বন করতে আরো সহজ হবে। কাজেই সতর্কতা সংকেতের তাৎপর্য শুধু ঝড়ের সময়ে না হয়ে সারা বছর এবং শুধু আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওপর ছেড়ে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকে সবার কাছে ভালোভাবে বার্তাটি শিখিয়ে-পড়িয়ে ও বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলেই মৃত্যুর সংখ্যা যেমন কমে ১০ লাখ থেকে ২৪ জনে নেমে এসেছে, তা একেবারে শূন্যের কোটায়ও আনা সম্ভব হবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।