ফেসবুকে কি সব জানাতে হবে?
টিভিতে চোখ রাখলেই স্বভাবতই যে বিজ্ঞাপন বেশি দেখা যায়, তা হলো মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর নানা অফার। আর সম্প্রতি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রি-রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি আসায় তা আরো বেড়েছে। অনেকে আফসোস করছেন, আগে কেন রি-রেজিস্টেশন করিয়েছেন, শেষ দিকে করালে কত অফার পাওয়া যেত। আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় মোবাইল ফোন অপারেটররা আগে যে হারে রিচার্জ বা একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি টাইপের বিজ্ঞাপন প্রচার করত এখন সে সংখ্যাটা অনেক কমে তা রূপ নিয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের কী সুবিধা বা কত গিগাবাইট ডাটা ফ্রি দিচ্ছে, কত টাকায় এসব ডাটা কতদিনে ব্যবহার করতে পারছে এসব। অনেকেই তো ফেসবুকের জন্য আলাদা অফারও রেখেছে। এসব নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে বুঝতে পারি, আমাদের দেশ ইন্টারনেট সেবা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
এমনকি আমরা বাইরেও আমাদের ব্যান্ডউইথ বিক্রি করছি। এক সহকর্মী সম্প্রতি চীন থেকে ফিরে জানালেন, ওরা নাকি সব জিনিসই বিভিন্ন কপি তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের কথা ধরলে, একই মোবাইল ওরা তৈরি করে বিভিন্ন ক্যাটাগরির। সেই চায়না মোবাইলের বিভিন্ন কপিতে আমাদের দেশ এখন সয়লাব। এই ফোনগুলোর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ‘একের ভেতরে অনেক কাজ।’ কথা বলো, মেসেজ পাঠাও, ইন্টারনেট, বাতি জ্বালাও, চার্জ লাইট হিসেবে ব্যবহার করো, কোনো কোনো মোবাইল শুধু সেলফি বিশেষজ্ঞ। কে জানে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মোবাইল দিয়ে রান্নাবান্নার কাজও করা যাবে। এসবই প্রযুক্তির সুফল। কিন্তু হনুমানের হাতে আগুন দিলে কী হয় সেটা লঙ্কাবাসী জানত। বাবা-চাচা বিদেশে থাকার কারণে এসব দামি দামি বা অল্প দামি কিন্তু কাজ অনেক এমন মোবাইল গিয়ে পড়েছে সমাজের হনুমান টাইপের কিছু মানুষের কাছে। এতে করে প্রতিদিন কোনো না কোনো দুর্ঘটনার খবর আমরা পাচ্ছি যা আপলোড হচ্ছে ফেসবুকে এবং ঘটছে নৈতিক অবক্ষয়।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, রংপুরে বাথরুমে দুই বান্ধবীর একসঙ্গে গোসল করার সময় সেলফি স্টিকের মাধ্যমে নগ্ন ছবি ধারণ করে দুই বখাটে এবং এর প্রতিবাদ করতে গেলে মেয়ে দুটির আত্মীয়স্বজনকে মারধর করা হয়। ওই দুই বখাটে ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় এবং তারা এটি যেকোনো সময় করতে পারে। এর প্রথম কারণ ইন্টারনেট এখন হাতের মুঠোয় আর ওরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। পুলিশ রহস্যজনকভাবে তাদের প্রেপ্তার করছে না বলে সংবাদে বলা হচ্ছে। শরীয়তপুরে প্রেমের অভিনয় করে যৌথ ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, রাঙমাটিতে সহজ সরল আদিবাসী মেয়েদের লোভ দেখিয়ে তাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাও ছড়ানো হচ্ছে ইন্টারনেটে। বিদেশি প্রজেক্টের অনেক বড় বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে। আবার বিপরীত দিকে যদি দেখা যায়, ফেসবুকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে অনেক সময় বিপদ ডেকে আনছে। ঢাকা কর্মাস কলেজের এক ছাত্র ও এক ছাত্রীকে বহিষ্কার এবং আরো নয়জনকে টিসি দেওয়া হয়েছে শুধু প্রেম নিবেদনের কারণে।
যদিও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন বলছে, প্রেম নিবেদন তো খারাপ নয়। কিন্তু এখানে একটি কথা থেকেই যায়। প্রেম নিবেদনের দৃশ্য ভিডিও করে এভাবে সারা বিশ্বকে জানানোর মধ্যে আপাত কোনো মহত্ব নেই। অনেকে বিষয়টির সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। আমার জবাবটা হলো এই, ওরা যে বয়সে প্রেম নিবেদন করছে সেটার পরিণতি যদি ভালো না হয় বা সেটা যদি বিকৃত রূপ নেয় সেটার দায়ভার কে নেবে? কারণ আমাদের সমাজ এখনো বিষয়গুলো মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি করতে পারেনি। তাই আগে দরকার আমাদের মানসিকতা উন্নত করা। আবার প্রেম করে ছবি তুলে রাখা, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া এসবের মধ্যে যে সবসময় ভালো উদ্দেশ্য থাকে তাও তো নয়।
এক সাংবাদিক সম্প্রতি একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যেটার মাধ্যমেই বোঝাতে পারি ফেসবুকে ছবি আপলোড করার সময় কেন সতর্ক থাকা উচিত। তিনি তার কিশোরী কন্যার ছবি আপলোড করেছিলেন কোনো একটা অনুষ্ঠানের। কিন্তু পরে তিনি সেই ছবি দেখতে পান ‘বাজে কথা সংলিত’ কোনো একটা পর্নো ওয়েবসাইটে। বিষয়টি তাকে আহত করে। যদিও তার মনোবল অটুট এবং নিজেকে বা মেয়েকে জানেন বলেই সেটা নিয়ে তেমন হা-হুতাশ করেননি। কিন্তু বিষয়টা তো ঘটল। অনেকের অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, সকালে উঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সব কাজই আমরা আপলোড করে চলেছি। শুধু ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া। আর সেই কাজটা করে দিচ্ছে বখাটেরা।
অনেক সময় প্রিয়জন বা প্রতিষ্ঠানের ওপর রাগ, ক্ষোভ বা অভিমান আমরা প্রকাশ করে থাকি ফেসবুকের মাধ্যমে। সেটার আঙ্গিক যদি শৈল্পিক হয় তবে তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু অনেক সময় নিজের পরিবারের অন্দরমহলের ঘটনা অন্যকে জানানোটা দৃষ্টিকটুই বটে! আবার এমনও ঘটেছে, যেহেতু সবকিছু ফেসবুকে জানানোয় আমরা অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছি, সে কারণে ব্যর্থতার ফাঁস গলে ঢুকে পড়ছে প্রতিহিংসা পরায়ণ, কপট কেউ। সম্প্রতি মডেল সাবিরা ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এবং এর জন্য তাঁর প্রেমিক আলোকচিত্রী নির্ঝর সিনহাকে দায়ী করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইঙ্গিত করেছেন, শারীরিক সম্পর্কে নির্ঝর যতটা আগ্রহী ছিল বিয়েতে ততটা নয়। প্রেম মহৎ সম্পর্ক। সেখানে ভালোবাসার সব রকমের প্রয়োগ হবে, কিন্তু কতটা বিষণ্ণ হলে, কতটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলে বা কতটা কষ্ট পেলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে, ভিডিও আপলোড করে একটা মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যারা তাঁকে সেই আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে তারাও এক শ্রেণির বখাটে। রংপুরের বখাটেরা হয়তো লেখাপড়া জানে না, আর এরা লেখাপড়া জানা। তাই বলা হয়, ‘লেখাপড়ায় বড় হলেই শিক্ষা তারে কয় না, অভ্যাস, ব্যবহার না হলে শিক্ষা কবু হয় না।’ জাতিকে শিক্ষিত করার দায়ভার কিন্তু রাষ্ট্রও এড়াতে পারে না।
আবার ফেসবুক যে অনেক আন্দোলনের সুতিকাঘর সেটাও অস্বীকার করা যায় না। ফেসবুক ছিল বলেই না শ্যামল কান্তি নাথের ঘটনায় সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা যাচ্ছে। নইলে এমন ঘটনা কতই না ঘটছে গ্রামে-গঞ্জে। সেসব অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। কেউ জানতেও পারছে না।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক