দৃষ্টিপাত
আত্মহনন ও একটি বিবেক!
নিতান্ত বাধ্য হয়েই লিখতে হচ্ছে এই বিষয়ে, অনেকটা বিবেক তাড়িত হয়ে। কষ্ট, ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ, মনোবেদনা, অন্তর্দহন অনেক কিছুই এই মুহূর্তে মনের ভেতর প্রতিক্রিয়া করছে, তাই না লিখে আর পারা যাচ্ছে না। ২৪ মে ২০১৬ সন্ধ্যা থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মধ্যম ফেসবুকের পাতা ভারি হয়ে যেতে থাকে হালের এক মডেলের আত্মহননের খবরে। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাস করা আনুমানিক ২১ বছর বয়সের এই মডেল। যার মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়, রূপনগরের একটি ভাড়া বাসা থেকে।
এটা আমাদের সবারই জানা, মডেলিং জগতের মানুষের জীবন যাপন নিয়ে সাধারণ মানুষের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। এরপর আবার যদি ঘটে কারো আত্মহত্যার ঘটনা। বাংলাদেশময় এই খবর ছড়াতে সময় লাগেনি। অন্য পাঁচটা অপমৃত্যুর চেয়ে এই ঘটনা অবশ্য নতুন বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। ফেসবুকে পোস্ট শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে শুধু সুইসাইড নোটই নয়, সাথে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে।
আমার এই লেখায় অবশ্য দোষী, অপরাধী, শাস্তি, শাসন ব্যবস্থা এসব কিছু নিয়েই আলোচনা করব না। শুধু নিজেকে নিজে হত্যা করা, কাম্য-মরণ এবং তার পরবর্তী সময়ে সাধারণের প্রতিক্রিয়া নিয়েই আলোচনা করব। আত্মহত্যা সমাজ থেকে নির্মূলই এই লেখার মুখ্য বিষয়।
প্রসঙ্গত, এই ঘটনার অবশ্য পুরো তথ্যই পাওয়া গেছে ফেসবুকে। আত্মহত্যাকারীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে আমার সাথে কিছুটা মিল থাকলেও কখনো দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। হয়তো সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠান দুটিতে ছিলাম না আমরা। তবে, আনাকঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটার পর, আমার মিডিয়ার অনেক পরিজন তাদের ফেসবুকের মাধ্যমে এই তরুণ মডেলের কথা জানান। ‘বেশির ভাগ’, কথাটা উল্লেখ করা ঠিক হবে না, বরং সবাই তাকে ভালো বলেই উল্লেখ করেছে। তাকে বেশির ভাগ মানুষ যেভাবে দেখেছে তারই প্রতিফলন হয়েছে। পোস্টটি শেয়ারের সাথে সাথে অনেকে কমেন্ট করে তাকে রুখতেও চেয়েছে। কাজ হয়নি। এ বিষয় নিয়েও কোনো আলোচলায় যাব না। তবে, তাকে মনোবেদনা নিয়ে দুনিয়ার মায়া ছাড়তে হয়েছে, এ কথা সত্য। দুনিয়ার মায়া ছাড়তে হয়েছে বলতে এক কথায়, বাধ্যই হয়েছে। আমরা যারা সুস্থ মস্তিষ্কে এই লেখা পড়ছি, তারা হয়তো ভাবতেই পারছি না, আত্মহত্যা করাটা কতটা কঠিন! জীবনযুদ্ধে সঞ্জীবিত সব শক্তিই যখন একটা মানুষ হারিয়ে ফেলে, তারই ফলাফল ‘আত্মহত্যা’। আর এইপর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে মানুষকে আসলেই তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে হয়। হয়তো তার জীবনই তাকে বাধ্য করেছে!
আত্মহত্যাকারী তার সুইসাইড নোটে অনেক তথ্যই দিয়ে গেছেন। অবশ্য আইনরক্ষাকারী বাহিনী যেহেতু বিষয়টি আমলে নিয়েছে, তাই রাষ্ট্রই ক্রমান্বয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সে বিষয়ে অবশ্য কোনো জটিলতা নেই।
ফিরে আসতে হচ্ছে আবার কাম্য-মরণ প্রসঙ্গে। মূলত, ফেসবুকে হত্যার পোস্ট শেয়ার করার পরই তিনি আত্মহত্যা করেন- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা চেষ্টা করেছেন তাঁকে এই পথ থেকে ফেরাতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর ছোট বেলার বন্ধু থেকে শুরু করে, কলিগ, বাদ যাননি কেউ। সব চেষ্টাই ব্যর্থতার খাতায়। অবশেষে তাঁর মরা দেহ উদ্ধারই করতে হলো বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের।
ভিডিওটিতে ছুরিসহ তাঁকে দেখা গেলেও, মৃতদেহ উদ্ধার হয় গলায় ফাঁসরত অবস্থায়। এটা মর্মান্তিক। সমাজ কোনো ভাবেই তার সহায় হতে পারেনি, তিনি নিজেও হারিয়েছেন তাঁর নিজস্ব সহায়, তাই বেছে নিয়েছেন এই নির্মম পথ। তিনি যে সহ্যসীমার বাইরে গিয়ে কাজটা করতে বাধ্য হয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে ভিডিওটি শেয়ার করেছেন, সেটা কতটা বিরূপপ্রভাব রাখে? আবার তিনি যে পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তটি নিতে বাধ্য হয়েছেন সেই সময়ে এই কাজের প্রভাব চিন্তা করাটাও সম্ভব নয়, তাতে দোষও হয়নি।
বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। যেখানে দুই কোটির কাছাকাছি ব্যবহারকারী ১৮-২৪ বছর বয়সী। যার মধ্যে ২২ শতাংশ মেয়ে। কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না এ দেশে ১৩ বছরেও ব্যবহারকারী আছে, পরিসংখ্যান যা বলে। এই অনুপাতও কম নয়, ১৮ শতাংশ। কে জানে এর চেয়েও কম বয়সী ব্যবহারকারী আছে কি না!
ভিডিওটিতে পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি দেখি না।
আমাদের মাঝ থেকে একজনকে হারিয়েছি। আর হারাতে চাই না। তাই কিছুটা সচেতন থাকতে হবে। আমাদের পাশের কেউ এমন মনোবেদনায় থাকলে, তাকে দূরে না ঠেলে দিয়ে সর্বোত্তম চেষ্টা দিয়ে যেকোনো মূল্যে তাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আনতে হবে। পরিবারের থেকে কোনো বয়সেই যেন, দূরে সরে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশে আর কোনোদিন যেন পুলিশকে ঝুলন্ত অবস্থায় কাউকে উদ্ধার করতে না হয়। আমাদের পরিবারের বা কাছের শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী স্বাভাবিক অবস্থায় আছে কি? তারা কি কোনো কারণে, উদ্বিগ্ন? তারা যেকোনো সমস্যাই যেন পরিবারের সাথে ভাগ করে নেয়।
ভুল যাই হোক, যে পরিমাণই হোক, সমাজ, ধর্ম বা রাষ্ট্রনীতি থেকে তা সংশোধনের ব্যবস্থা আছে। সুতরাং যেকোনো মূল্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদেরই দায়িত্ব নিতে হবে, অনুজদের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে। আবেগ, অনুভূতি, পরিবেশ, বিষণ্ণতা, কটাক্ষ, মানসিক অস্বস্তিবোধ, অপরাধবোধ, বিবিধ-সম্পর্ক, কটূক্তি, অসদ্ব্যবহার, পারিবারিক-সামাজিক অশান্তি, সম্পর্কের টানাপড়েন, লজ্জা ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহনন করে। আপনি, আমি যেকারোই সাথে, যেকোনো সময়েই এই কারণ ঘটতে পারে। তবে, তাই বলে জীবন শেষ করে ফেললে চলবে না। দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করতে হবে। আর, পরিবার তো পাশে থাকা চাই-ই চাই। আর কিশোর বয়সে যেহেতু, এই প্রবণতা বেশি, তাই তাদের প্রতি বেশি সচেতন হতে হবে। বিশ্বে বছরে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশ বা তার কম বেশি তরুণ এবং ৮৯ শতাংশ মেয়ে। সুতরাং সংখ্যা উপেক্ষণীয় নয়। আপনাকে আমাকে সবাই মিলে, সমাজ থেকে এই ব্যাধি নির্মূল করতেই হবে। আসুন এগিয়ে আসি। নিজের পরিবারের জন্যই।
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
লেখক : প্রকৌশলী