অর্থনীতি
উচ্চাভিলাষী বাজেটের সম্ভাবনা ও শঙ্কা
জাতীয় সংসদে উত্থাপন হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। প্রতিবারের মতো এবারও এটাকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নানা মুনি নানা মত দিচ্ছেন, প্রশ্ন তুলছেন; তবে উপায় বলছেন না বেশির ভাগ সমালোচক। এখন ধরুন, এ বাজেট ঠিকই বাস্তবায়ন করা গেছে। তাহলে অবশ্যই এটি ভালো বাজেট হিসেবে দেখা হবে।
বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজন আগে দেশের অর্থনীতি বিকাশের প্রতিবন্ধকতা দূর করা। আর সে জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সমস্যার সামাধান বের করা। এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যাকে বাজেট বাস্তবায়নের পথে প্রধানতম সমস্যা বলে আমি মনে করি। সেটি হচ্ছে বিনিয়োগ স্থবিরতা। বিনিয়োগের গতি শ্লথ থাকলে সরকারের আয় কমবে, আর তা বাজেটের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি। এটি নিয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার অনেক বড়। বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এ টাকা সরকারকে তা জোগাড় করতে হবে। তবে বাজেটে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আদায় করতে হবে দুই লাখ তিন হাজার ১৫২ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। ফলে আয় আরো বাড়াতে দরকার বিনিয়োগ বাড়ানো।
বর্তমানে ১১ লাখের কিছু বেশি মানুষ কর দেয়। এই সংখ্যা বাড়াতে হলে দেশে উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নতুন প্রতিষ্ঠান হলে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। করের আওতা বাড়বে। দেশ এগিয়ে যাবে।
নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে, সেগুলোর যদি সামাধান করা যায় তাহলে বিনিয়োগ বাড়তে থাকবে।
এখন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে, সেগুলো নিয়ে বলতে চাই।
একজন বিনিয়োগকারী যখন বিনিয়োগ করেন, তখন ভাবেন তাঁর বিনিয়োগটা কতটুকু নিরাপদ ও কতটা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখন কেউ নতুন কোনো ব্যবসা শুরু বা শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হন, তখন তাঁকে কিছু সরকারি লাইসেন্স নিতে হয়। যেমন—ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেট, ভ্যাট রেজিট্রেশন এবং ম্যানুফ্যাকচারির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতিপত্র, আইআরসি, ইআরসি, মূসক-৭, ফায়ার লাইসেন্স ইত্যাদি। শিল্পক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেমন—শিল্পের জন্য জমি পাওয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রাপ্যতা এবং ব্যংক ঋণ নিশ্চিত ইত্যাদি। এসব বিষয়ের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যখন একজন বিনিয়োগকারী সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন বলে মনে করেন, একমাত্র তখনই তিনি বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমান বাস্তবতায় দেখা যায়, এসব বিষয় সম্পন্ন করতে একজন বিনিয়োগকারীর অনেক বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আর তখনই তিনি বিনিয়োগ করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন। আমি মনে করি, এসব সমস্যার সহজ সমাধান আছে।
সরকারের উচিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়ানো। আর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য মার্কেটিং পলিসি গ্রহণ করা, যেমনটি আমরা ব্যবসায়ীরা পণ্যের মার্কেটিং করি। এ ক্ষেত্রে সরকার একটি প্রতিষ্ঠান চালু করবে, যার কাজ হবে কনসালট্যান্সি করা। এ প্রতিষ্ঠানে কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে, কিন্তু তাঁদের কোনো বেতন দেওয়া হবে না। এ কোম্পানির কোনো নিজস্ব অফিস থাকবে না, কিন্তু একটি ওয়েবসাইট থাকবে। এই ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য দেওয়া থাকবে এবং কাজের ধরন অনুযায়ী কার কত কনসালট্যান্সি ফি, তা উল্লেখ করা থাকবে। ওই ফি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে বিনিয়োগকারীদের তাঁদের ব্যবসার শুরু থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সে ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। যেমন—লাইসেন্স করতে সাহায্য করা, জমি পেতে সাহায্য করা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে ওই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শকদের কাজ। একজন উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীকে হয়রানি বা সমস্যা থেকে রেহাই দিতে সাহায্য করাই হবে প্রতিষ্ঠানটির কাজ।
এ জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত ব্যক্তিদের এসব কাজের বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাঁদের একটি আইডি কার্ড দিতে হবে, যাতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তাঁদের চিনতে পারে। তাঁদের কাজে যদি কেউ অন্যায়ভাবে বাধা সৃষ্টি করে, সে ক্ষেত্রে তাঁদের সুস্পষ্ট অভিযোগের মাধ্যমে দ্রুত আইনি সহায়তা দিতে হবে। এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় প্রচার চালাতে হবে। যেহেতু সরকার ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কোনো বেতন দেবে না, সেহেতু সরকার তাদের প্রতিটি কাজের জন্য ফি নির্ধারণ করে দেবে। ওই ফির টাকা উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী ওই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেবে। এতে ওই ব্যক্তি সঠিকভাবে কাজ না করলে বিনিয়োগকারী প্রতিকার পাবে। যেহেতু কনসালট্যান্সি করার মাধ্যমে ওই কর্মকর্তাদের আয় বাড়বে, সেহেতু ওই কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগেই নিজের দক্ষতা বাড়াবে এবং নিজের প্রচারে উৎসাহিত হবে। এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্যবসায়িক ধারণা দিয়ে নতুন নতুন বিয়োগকারী আর্কষণের ক্ষেত্রেও কাজ করবে। আর এ পদ্ধতির মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন উৎসাহিত হবেন, তেমনি নতুন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রও সৃষ্টি হবে। আর এর দ্বারা করের আওতাও বাড়বে।
নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন রকম প্রণোদনা ও কর রেয়াত ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। এ ছাড়া শিল্পের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জমির ব্যবস্থা করা। এসইজেড নামে যে শিল্প প্লটের কথা বলা হচ্ছে, তার কার্যক্রম শুরু না হওয়াটা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বাধা। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদহার কমাতে বলা হলেও ব্যাংকগুলো তা কমাচ্ছে না। এসএমই খাতে ব্যাংক ঋণ পর্যাপ্ত দেওয়া হচ্ছে না। এসব বিষয়ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাজেটে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সময়মতো মেগা প্রকল্পগুলো শেষ করতে পারলে তা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু তা ঠিকমতো বণ্টন হচ্ছে না। তাহলে তো তা উপকারে আসবে না। এদিকে, সরকারের নজর দেওয়া উচিত। নতুন জ্বালানি উৎস এলএনডি লিকুইড গ্যাস প্ল্যান্টের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা এখনো শুরু হয়নি, এটি বিনিয়োগের বাধা।
আমাদের দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় বাধা হলো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার মানটা ঠিক আছে কি না, সেদিকে নজর দেওয়া এবং সেই সঙ্গে গবেষণামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। তা না হলে নতুন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে হবে।
বর্তমানে সব কৃষক চাষাবাদ করে লাভ করতে পারছেন না। সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। কৃষক ও সরকারের মধ্যে একটি সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা জরুরি, যাতে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত তার সমাধান করা যায়। একটি নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থাও আনা দরকার, যাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
‘পরিবেশবান্ধব বাজেট চাই’ শিরোনামে আমার লেখা একটি নিবন্ধ বাজেট ঘোষণার আগে অনলাইন ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যদিও বাজেটে জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশ নিয়ে একটি অধ্যায় আছে।
কিন্তু পরিবেশবান্ধব পণ্য বা পরিবেশবান্ধব শিল্পের ব্যাপারে বাজেটে তেমন কোনো কিছু নেই। পরিবেশের ব্যাপারটা বাজেটে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। দেশের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে পরিবেশবান্ধব শিল্পের প্রসারে বাজেটে বিশেষ ঘোষণা আশা করি।
সর্বোপরি, বাজেট বাস্তবায়নে যাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যাঁদের পেছনে বাজেটের ২২.২ শতাংশ টাকা খরচ হবে, সেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের সব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
লেখক : স্বত্বাধিকারী, কেপিসি ইন্ডাস্ট্রি, বর্ষসেরা জাতীয় এসএমই শিল্পোদ্যোক্তা, ২০১৬ পুরস্কার বিজয়ী।