অভিমত
বর্ষপূর্তিতে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিল এনটিভি
নব্বই দশকের মাঝামাঝি স্যাটেলাইট চ্যানেলের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। সিএনএন, বিবিসি, ইএসপিএন ইত্যাদি খবর ও খেলাধুলার চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে এর প্রবর্তন সূচিত হয়। তারপর বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে থাকে ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলগুলো। ধুম-ধাড়াক্কা নাচ-গানের এসব চ্যানেল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এনজয় করতাম। তারপর চাকরিজীবনে চলে যাওয়ার পর যেসব জায়গায় চাকরি করেছি, সেখানে বিটিভি ছাড়া আর কোনো চ্যানেল দেখার সুযোগ হতো না। আর হলেও টিভি এন্টেনাতে অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি-বাটি লাগিয়ে ভারতীয় ঝিরঝির করা দু-একটি হিন্দি চ্যানেল কোনোরকমে কষ্টে-সৃষ্টে দেখার চেষ্টা করা হতো। তবে সে সময় বিটিভির মতোই টেরিস্ট্রিয়াল সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন একুশে টিভি চললে তা দেখার সুযোগ পাই কিছুদিন। তারপর একে একে চালু হতে থাকল এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই ইত্যাদি টেলিভিশন চ্যানেল। সে চ্যানেলগুলো আস্তে আস্তে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি খবর পরিবেশন শুরু করে।
ঠিক সেই সময় সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে যাত্রা শুরু করল এনটিভি স্যাটেলাইট চ্যানেল। আমি তখন ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় কৃষি বিভাগে চাকরি করি এবং উপজেলা কোয়ার্টারেই সপরিবারে অবস্থান করি। তখনো উপজেলা সদর পর্যন্ত কেবল নেটওয়ার্কিং শুরু হয়নি। ২০০২ সালের দিকে আমরা যারা উপজেলা কোয়ার্টারে থাকি, তারা সবাই মিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ভালো করে ধরলাম যে, সারা দেশের অনেক স্থানেই তখন ক্যাবল নেটওয়ার্ক থাকলেও আমাদের ফুলপুর উপজেলায় নেই। কাজেই আমাদের যে করেই হোক ক্যাবল টিভি দেখার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, নয়তো আমরা বর্তমান বিশ্ব থেকে ছিটকে পড়ছি। সেদিন ইউএনও সাহেব আমাদের কথা শুনে ক্যাবল টিভির ব্যবস্থা করে দিলেন। চালু করতে করতে ২০০৩ সালের জুন মাস লেগে গেল। আমাদের বাসায় ক্যাবল টিভি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটিএন বাংলা এবং চ্যানেল আইতে বিজ্ঞাপন দেখা গেল যে, আগামী ৩ জুলাই ২০০৩ এনটিভি নামের আরেকটি স্যাটেলাইট চ্যানেল শুরু হতে যাচ্ছে।
মনে মনে খুবই উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলাম। কারণ বাংলাদেশে আরো স্যাটেলাইট বাংলা চ্যানেল শুরু হতে যাচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠানের একটি প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং খবরের মানও বাড়বে। দেখতে দেখতে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন (৩ জুলাই ২০০৩) অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে যাত্রা শুরু করেছিল এনটিভি। তখন মফস্বলে থেকে বিনোদন ও জ্ঞানচর্চা করার মতো মাধ্যম পাওয়া গেল। একসময় মনে করা হতো টেলিভিশন শুধু বিনোদনেরই চাহিদা মেটায়, কিন্তু বর্তমানে টিভি চ্যানেলগুলোতে সব বয়সের সব সময়োপযোগী অনুষ্ঠান নির্মিত হয়ে থাকে। এ দৌড়ে এনটিভি সব সময়ই এগিয়ে। এনটিভি শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তারাই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে সংগীতের অত্যন্ত জনপ্রিয় ওপেন কন্টেস্ট রিয়েলিটি শো ‘ক্লোজ-আপ ওয়ান, তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ শুরু করেছিল।
এ অনুষ্ঠানটি সে সময় এমন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, তার যে একটি টাইটেল সং ‘যদি লক্ষ থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবে হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে...’ সবার মুখে মুখে ছিল। স্থান পেয়েছে অনেকের মোবাইলের রিং টোন হিসেবেও। সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য তখন রাস্তাঘাট, হাট-বাজার ফাঁকা হয়ে যেত। অনেকে বিদ্যুৎ না থাকলেও যাতে অনুষ্ঠানটি মিস না হয় সে জন্য আলাদাভাবে জেনারেটরের ব্যবস্থা করে রাখতেন। অনুষ্ঠানে গান শোনার পর এসএমএস করার হিড়িক পড়ে যেত। নোলক বাবু, রাজীব, বিউটিসহ আরো কমপক্ষে একডজন মানসম্পন্ন শিল্পী তৈরি হয়েছে প্রথমবারে। পরবর্তী সময়ে সালমা, মুহিন, লিজাসহ এমন আরো অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পী সৃষ্টি হলো, যারা এখন সবাই দেশে-বিদেশে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। ভালোই চলছিল ‘সময়ের সাথে আগামীর পথে’ স্লোগান নিয়ে এনটিভি।
কিন্তু ২০০৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এনটিভির জীবনে নেমে এলো এক ভয়াবহ দুর্যোগ। সেদিন বিএসইসি ভবনে আগুন লেগে এনটিভি এবং তার তৎকালীন সিস্টার কনসার্ন আরটিভি স্টুডিও আগুনে পুরে ছাই হয়ে যায়। সেটি নিয়ে আমার একটি স্মৃতি আজও মনে পড়ে। তখনকার আমার তিন বছর বয়সী ছেলে নাফি এনটিভির সেই রিয়েলিটি শো দেখে দেখে রাতের খাবার খেত। এনটিভিতে আগুন লাগার পর আমার সেই নাফি পর্যন্ত ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে সেদিন আমাকে অফিসে মোবাইল ফোনে বলেছিল, ‘আব্বু আমাদের টিভিতে আগুন লেগেছে।’ পরে আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করেছিলাম সেদিন। তার মানে হলো- এনটিভি সেদিন আমার তিন বছরের নাফিরও নিজের টিভি হতে পেরেছিল।
যা হোক, এনটিভি পরিবার পরে তাদের মনোবল নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। চলতে চলতে আজ অবধি তারা ১৩ বছর পূর্ণ করল। ভাবতে অবাকই লাগে। কেমন করে সময় চলে যায়। এই তো সেদিনের কথা। এরই মধ্যে ১৩ বছর পেরিয়ে ১৪ তে পা দিল ভাবাই যায় না। চলার শুরু থেকে এনটিভি শুধু প্রথাগত অনুষ্ঠান প্রচার নয়, তারা পালন করেছে অনেক সামাজিক দায়বদ্ধতা। সেই সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বর্তমান ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে টেলিভিশনে সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি অনলাইন একটি নিউজ পোর্টাল চালু করেছে।
যে কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে সমসাময়িক সংবাদ বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এটি বর্তমানে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আমি নিজেও সেখানে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে আমার মতামত দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি, সে জন্য এনটিভি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গতকালই (০২-০৭-২০১৬) হঠাৎ করে আমার মনে হলো এনটিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কথা। সেখানে দেখছিলাম বিশেষ বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানমালার কথা। কিন্তু গত শুক্রবার (০১-০৭-২০১৬) গুলশানে ঘটে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক এক জিম্মি ঘটনার প্রেক্ষিতে সেখানে দেশি-বিদেশি ২৮টি প্রাণ ঝরে পড়লে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুদিনের শোক ঘোষণা করা হয়। সেই শোকের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এনটিভি তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সব অনুষ্ঠান প্রত্যাহার করেছে। এটাই হলো এনটিভির দায়িত্বশীলতা। তাই ১৪তম জন্মদিনে এনটিভিকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। এভাবে নিরপেক্ষতায় এনটিভি টিকে থাকুক আরো শত-সহস্র বছর।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়