গুলশান ৭/১
বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো!
সমসাময়িক বাংলাদেশের ইতিহাসে গুলশান ট্র্যাজেডি সবচেয়ে নির্মম সন্ত্রাসী ঘটনা। এতে জীবনের যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তেমনি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের ইমেজ ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছে। আর লাভবান হয়েছে তারাই, যারা বাংলদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় জটিল কুটিল রাজনীতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। রাজনৈতিক দোষারোপের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না আমাদের জাতীয় স্বার্থ।
এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি বাংলাদেশে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু জিম্মি করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এই প্রথম। এই ঘটনা এমন সময়ে ঘটল, যখন সরকার বজ্র আঁটুনি দিয়ে সন্ত্রাস দমনে ব্যস্ত। গত সপ্তাহে সরকার ঘোষিত যৌথ অভিযানে ১৫ হাজার মানুষ গ্রেপ্তর করা হয়েছে। পুলিশি ভাষ্যে বলা হয়েছে এর মধ্যে ২০০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি। মানুষ প্রশ্ন করেছিল, তাহলে বাকিরা কারা? সংবাদপত্র উত্তর দিয়েছিল- এসব ঈদ-বাণিজ্য। এত সবের মধ্যেও যখন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ল না, তখন ঈদ-বাণিজ্য আর রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিয়োগ সত্য প্রমাণিত হলো না! পুলিশ যখন বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধারের গল্প শোনাচ্ছে, তখন আধুনিক গোলাবারুদসহ অবাধে সন্ত্রাসীরা রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়েছে। গুলশানের মতো নিবিড় নিরাপত্তাবলয়ে হামলা হলো। এর আগে যখন বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলা হলো, তখন কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য বারকয়েক তাগাদা দিয়েছে। প্রতিবারই সরকার নিরাপত্তা জোরদার করার কথা বলেছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, সি সি ক্যামেরা এবং বজ্র আঁটুনি কি তাহলে ফস্কে গেল? মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে বিদেশি কয়েকটি দূতাবাস সরকারকে আরো হামলার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছিল।
হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা এবং দীর্ঘ সময় পরে কমান্ডো অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে বলা হয়েছে, ১ জুলাই রাত প্রায় পৌনে ৯টায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় ২ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ড’ শুরু হয়। ৮টা ৩০ মিনিটে অপারেশনের বিয়োগান্তক অবসান ঘটে । কেন ১০ ঘণ্টা পরে, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কেন নয়- এ প্রশ্ন অনেকের। তা ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের যে চিন্তা করা হয়, তা কেন? এ ধরনের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কী আলোচনা করা যায়? এর আগে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে। কারণ তারা ‘সন্ত্রাসী’। হামলার শুরুতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ উদ্যোগ নেয়। এতে পুলিশের দুজন কর্মকর্তা নিহত হয়। আহত হয় আরো ৩৫ জন। যারা কর্তব্য পালন করতে গিয়ে জীবন দিলেন, তাদের প্রতি সম্মান রেখেই প্রশ্ন তোলা যায়- এই প্রাথমিক উদ্যোগ কি বাস্তবসম্মত ছিল? রণকৌশলবিদরা ঘটনাটিকে বিডিআর ট্র্যাজেডির সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেখানেও সময়ক্ষেপণ, দীর্ঘসূত্রতা এবং আলোচনার আহ্বান ছিল। এখানেও অনুরূপ ব্যর্থতা আছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। যাদের জীবন রক্ষার জন্য অভিযান, তারাই যদি বেঁচে না থাকল তাহলে অভিযানের সার্থকতা কোথায়?
এ জঘন্য হামলার কারণ নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। বিজ্ঞজনরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং আদর্শিক কারণ নির্ণয় করছেন। হয়তো বা এসব কারণই সত্য। সন্ত্রাস নতুন কিছু নয়। ইতিহাসের মতোই এটি পুরোনো। সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা সন্ত্রাসের দুটো পর্যায় নির্ধারণ করেছেন- আন্তর্জাতিক এবং রাষ্ট্রিক। অন্যভাবে বলা যায় বৈশ্বিক এবং স্থানীয় । ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর সন্ত্রাস নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। সেই থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হান্টিংটন কথিত ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ তীব্রতর হয়েছে। সিনিয়ার বুশ অসতর্কভাবে এই দ্বন্দ্বকে ‘ক্রুসেড’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মূলত সেটিই ছিল অপ্রিয় সত্য। বুশ মধ্যযুগের সেই ধর্ম যুদ্ধ শুরু করে ছিলেন। তারা আফগানিস্তান এবং ইরাক দখল করে নিয়ে ছিলেন। পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যের মিসর, লিবিয়া, সিরিয়ায় এবং ইয়েমেনে অব্যাহত গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছেন। ফিলিস্তিনি জনগণকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু জাতিতে পরিণত করেছেন- বুশের পূর্বসূরিরা। তাদের কর্মফলে হাজার হাজার মানুষ যখন ইউরোপ অভিমূখে অভিবাসী, তখন তারা সেখানে অবাঞ্ছিত। কারণ তারা মুসলমান। মুসলমানদের খেলাফত তথা তুর্কি সাম্রাজ্যকে তারা তছনছ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের নির্ভরতার জায়গা সোভিয়েত ইউনিয়নকে তারা ধ্বংস করেছে। এখন মুসলমান তথা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ সাম্রাজ্যবাদের ‘নতুন বিশ্ব আদেশে’ বন্দি।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখন একক বৈশ্বিক পরাক্রমের কাছে একান্তই অসহায়। সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থ অনুযায়ী দেশে দেশে শিখণ্ডি তৈরি করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদ চায় তৃতীয় বিশ্বের জনগণ ‘তাদের কথা তাদের আদেশ পালন করুক অক্ষরে অক্ষরে’। তাই তারা তৈরি করে ওসামা বিন লাদেন এবং বাংলা ভাই। যখন উল্টে যায় সমীকরণ, তখন বন্দুক ঘুরিয়ে ধরে ওসামা বিন লাদেনরা। মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি সম্বল করে সৃষ্টি করা হয় ইসলামী স্টেট নামক খেলাফত। উল্লেখ্য যে, পরস্পর বৈরী সৌদি আরব এবং ইরান উভয় মনে করে আইএস বা ইসলামী স্টেট ইসরাইলের সৃষ্টি। যেমন প্রথম মহাযুদ্ধকালে তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব খেলাফতের দাবিকে যেমন দাঁড় করানো হয়েছিল।
সারা পৃথিবীব্যাপী অত্যাচারিত, অপমানিত, নিপীড়িত এবং নিগৃহীত মুসলিম মানসকে বিভ্রান্ত করা খুবই সহজ। সেকুলার শিক্ষা সত্ত্বেও তাদের কাউকে না কাউকে আবেগতাড়িত করে জেএমবি বা আইএসে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। গুলশান ট্র্যাজেডি তার প্রমাণ। নিহত ছয়জনই উচ্চশিক্ষিত এবং ধনী পরিবারের সন্তান। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে হয়তো এরা শামিল হয়েছে। আর স্থানীয় শাসকদের সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট অনুরূপ কার্যকলাপ তাদের ক্ষোভকে বাড়িয়ে তুলেছে। সাম্রাজ্যবাদ এবং তার স্থানীয় এজেন্টরা যদি গণতন্ত্রের অবাধ সুযোগ দিয়ে তাদের উত্তেজনা প্রশমনের এবং ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ দেয় তাহলে রাজনৈতিকভাবে সন্ত্রাসের অবসান সম্ভব। প্রেসিডেন্ট উড্র উইলসন বলেছিলেন, ‘পৃথিবী গণতন্ত্রের মাধ্যমেই নিরাপদ করা সম্ভব।’
লেখক : সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।