প্রতিক্রিয়া
ঈদের দিন সন্ত্রাসী হামলা কেন?
দেশকে ক্রমাগতভাবে একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের যে প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন যাবৎ চালানো হচ্ছে, তার সর্বশেষ ছোবল হলো পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কাছে পরিকল্পিতভাবে বোমা হামলা ও গোলাগুলি চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ খুন করা। এক মাস ইসলাম ধর্মের বিধানমতে সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে সংযম প্রদর্শনপূর্বক বহু আকাঙ্ক্ষিত খুশির ঈদ উদযাপনের জন্য যখন পুরো জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ ময়দানে যখন দূর-দূরান্ত থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের অশেষ সওয়াব হাসিলের জন্য বৃহত্তম ঈদ জামাতে নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই সেই মাঠের অদূরে আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছে একদল সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালায়।
সেখানে ঝলসে ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের শরীর। সেখানে বোমার আঘাতে ও স্প্লিন্টারে মারাত্মক আহত পুলিশ সদস্য জহিরুল কিশোরগঞ্জ সদর আধুনিক জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। সেখানে মারা যায় এক হামলাকারীও। পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য অভিযান চলাকালে পার্শ্ববর্তী এক নারী নিহত হন সেখানে। আহত সাত পুলিশ সদস্যকে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ সিএমএইচে আনার পথে আনসারুল নামের আরেক পুলিশ সদস্য নিহত হন। আর বাকি ছয় পুলিশ সদস্যকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়েছে। অর্থাৎ ঈদের খুশির দিনের এ হামলায় সেখানে দুই পুলিশ সদস্যসহ মোট চারজনের মৃত্যু হয়েছে যা খুবই অনভিপ্রেত।
এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়কালে আবারও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের নামে যারা নামাজ আদায় না করে ধর্ম পালনরত অবস্থায় মানুষ খুন করে, তাদেরকে কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না। পবিত্র ঈদের দিনে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজে একদিকে একটু সাময়িক ভীতির সৃষ্টি হলেও সারা দেশে একে চরম ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। সবারই একই প্রশ্ন। এরা কারা? এরা কী চায়? কেন করছে এসব?
এরা নাকি ইসলাম প্রচার করার জন্য এসব করছে। যেখানে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈদের জামাতে নামাজ আদায় তাদের পছন্দ হয় না, তারা নাকি কথিত ইসলাম প্রচারের জন্য অমুসলিম নিধন করছে। এই তো সেদিন পয়লা জুলাই রমজানের ভেতরে পবিত্র লাইলাতুল কদরের ঠিক আগের রাতে গুলশানের অভিজাতপাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে এক জিম্মি সংকটের মাধ্যমে অমুসলিম নিধনের অংশ হিসেবে (!) নাকি অমুসলিম ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। তাদের কাছ থেকে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, ইমাম, মুয়াজ্জিন, পুরোহিত, ফাদার, ধর্মযাজক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, ব্লগারসহ কোনো ধর্মের কোনো ধর্মগুরু এমনকি মুক্তচিন্তার কেউ-ই রেহাই পাচ্ছেন না। এর সর্বশেষ সংযোজন হলো শোলাকিয়া মাঠের এ হামলা। অথচ এ মাঠের ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যের জন্যই এখানে নামাজ আদায়ের জন্য প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে থাকে।
আলেম-ওলামাদের ভাষ্যমতে, তৃতীয় মুসলিম গণজমায়েত এবং উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। ঠিক মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই প্রত্যেকটি টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখি সেই ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলার খবর। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যে লালিত মহুয়-মলুয়া ও মৈমনসিংহ গীতিকা’র চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত, জঙ্গলবাড়ি ঈশা খাঁ ও এগার সিন্ধুরের লালিত পবিত্র শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ এখানে যুক্ত করেছে মুসলমানদের জন্য এক পবিত্র ভূমি। মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকার গুলশানে একটি বড় ঘটনা ঘটার পর দেশজুড়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শোলাকিয়া মাঠকে ঘিরেও ছিল অন্যবারের তুলনায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, ঈদগাহ মাঠকে কেন্দ্র করে এবারে যদি বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা না নেওয়া হতো তাহলে হয়তো আরো বড় ধরনের নাশকতা হতে পারত। এ রকম একটি পবিত্র ভূমিতে প্রায় দুইশো বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে নস্যাৎ করার জন্য মূলত পূর্বপরিকল্পিতভাবে এ ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এরা আসলে ধর্ম প্রচারক নয়, ধর্মীয় জঙ্গিও নয়। এরা মূলত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিকল্পিত হত্যাকারী। যে কোনো মূল্যে দেশকে অস্থিতিশীল করাই তাদের লক্ষ্য। এরা দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করতে চায়। দেশকে বিশ্বে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণে সচেষ্ট রয়েছে এরা। তবে বাঙালি বীরের জাতি। যে কোনো দুর্যোগ সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। আবারও সেই সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। এই মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ধরা হয়েছে তাদের কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে অস্ত্র, অর্থ ও নির্দেশদাতাদের খুঁজে বের করার প্রয়াস চালাতে হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়