নগর
ঈদে অচেনা ঢাকা
এখন থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে ১৬১০ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে ও কালের ধারায় আজ সেই ঢাকা শহর যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় তা আগে মোটেও এ রকম ছিল না। এখন ঢাকা শহরে থেকে যারা তাদের রুটি রুজি করে অথবা শুধুমাত্র কর্মের ও জীবন-জীবিকার খাতিরেই সেখানে থাকতে বাধ্য হয়, এমন লোকজন ছাড়া কেউই আজকাল আর ঢাকা শহরে থাকতে চায় না। বিভিন্ন কারণেই ঢাকা শহর এখন নাগরিকদের জন্য বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
ঢাকা কালক্রমে শহর থেকে নগর ও নগর থেকে এখন মহানগরে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে ঢাকা পরিণত হয়েছে এক আতঙ্কের নগরীতে। সারা বছর যানজট, বর্ষাকালে জলজট, ছিনতাই, খুন-খারাবি, ধর্ষণ, ছেলেধরা, গুন্ডামি-ভন্ডামি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জাল টাকা ছড়ানো, ধাপ্পাবাজি, খাদ্যে ভেজাল মেশানো, অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য, কালো বাজারি, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণসহ সার্বিক পরিবেশদূষণ ইত্যাদি যেন এখন ঢাকা শহরের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই যেন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে। যদিও বা বর্তমান সরকারের আমলে আগের তুলনায় এসব নাগরিক সমস্যা অনেকাংশেই কম, তবু একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে উঠতে পারেনি। এগুলোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটিই দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার জনসংখ্যা এখন প্রায় দুই কোটি। জনসংখ্যার এ পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলেছে। আর সে জন্য জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনদিনই ঢাকা শহরের আয়তনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি এবং বর্তমানে এর অবস্থান নয়ম স্থানে। তা ছাড়া জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা শহর বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘনবসতিপূর্ণ মহানগর। আর বাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় বিশ্বে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। জনসংখ্যার চাপ সামলে নাগরিকদের আরো কার্যকরভাবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত করার জন্য ঢাকা শহরকে দুটি সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সিটি করপোরেশন এলাকার আওতাও। এ তো গেল রাজধানী ঢাকা শহরের খারাপ দিকগুলো। এর অনেক ঐতিহ্যবাহী ও গর্ব করার মতো অনেক দিকও রয়েছে। উন্নত বিশ্বের মতো ঢাকায় এখন রয়েছে অনেকগুলো উড়াল সেতু, রয়েছে হাতিরঝিলের মতো দর্শনীয় চক্রাকার স্থান, রয়েছে বিখ্যাত আর্কিটেক্ট লুই আই কানের নকশায় স্থাপিত বাংলাশের জাতীয় সংসদ ভবন, রয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রয়েছে ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতে স্থাপিত শহীদ মিনার। রায়ের বাজার ও মিরপুরে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার হানাদার বাহিনীর অতর্কিতে হামলায় নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও বদ্ধভূমি, রয়েছে কার্জন হল, রয়েছে আহসান মঞ্জিল, শিশু পার্ক, জাতীয় জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, একসময়ের বিরান রেসকোর্স ময়দান এখন সবুজ গাছ ও বনানীতে ভরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রয়েছে চন্দ্রিমা উদ্যান, বলধা গার্ডেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, শিশুমেলা, ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় বিস্তৃত করা হয়েছে পরিবেশবান্ধব মডেল টাউন।
তা ছাড়া এখন সেখানে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে অন্যতম এক বিনোদনকেন্দ্র ফ্যান্টাসি কিংডমসহ আরো অনেক বিনোদনকেন্দ্র। রয়েছে অনেক শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে গ্রাজুয়েট বের হয়ে এবং গবেষণা অবদান রেখে দেশকে উন্নতির শিখড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। খেলাধুলার জন্য গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানের মিরপুর ও গুলিস্তানের ক্রিকেট ও ফুটবল স্টেডিয়াম। তবে ঈদের ঢাকা সম্পূর্ণ অন্যরকম। এ ঢাকাকে যেন কেউ চিনতে পারে না। কারণ ঢাকা শহরে যেসব নাগরিক বসবাস করেন, তাঁদের শতকরা আশি ভাগের বেশি মানুষের শেকড় হলো গ্রামে। তাদের প্রত্যেকেরই আপনজন কেউ না কেউ গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মুসলিমপ্রধান আমাদের এ দেশে বছরে দুটি ঈদ। সেই ঈদের ছুটি পেলে গ্রামে থাকা তাদের স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেকড়ের টানে সেখানে ছুটে চলে। নাড়ির টানে সেসব মানুষগুলো রাজধানী ঢাকা শহর ছেড়ে গেলে রাজধানী কিছুটা ফাঁকা হয়ে যায়।
এক হিসেবের মাধ্যমে জানা গেছে যে, ঈদে রাজধানী ঢাকা শহরে থাকা প্রায় দুই কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় এক কোটি মানুষ গ্রামাঞ্চলে ছুটে চলে যায়। সে সময় রাজধানীর চিরচেনা, চিরপরিচিত সেই চেহারা একেবারেই পাল্টে যায়। তখন ঢাকায় থাকে না যানজট, জলজট, বায়ুদূষণসহ অন্যান্য কারণে পরিবেশদূষণ। মানুষ সহজেই এক স্থান থেকে অন্যস্থানে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে। রাস্তাঘাট এমন ফাঁকা হয়ে যায় যা কখনো কল্পনাই করা যায়না। এসব ফাঁকা রাস্তাঘাটকে কখনো কখনো ছোট বাচ্চাদের ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার মাঠ হিসেবেও ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। দেশের যখন একসময় কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল কিংবা অবরোধ থাকতো, তখনো এমন অবস্থা পরিলক্ষিত হতো। এ ঈদের ছুটির ভিতর ঢাকা শহরে আছেন এমন অনেকের প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেছে যে, আগে ঢাকা যে জায়গায় যাওয়ার জন্য যানজটের কারণে কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগতো সেখানে এখন মাত্র পাঁচ মিনিট সময়ই যথেষ্ট। রিক্সা দিয়েই চলে যাওয়া যাচ্ছে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে অতি সহজেই। আসলে একটি আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব নগরীর তো এরকমই থাকার কথা ছিল। কিন্তু নগর সভ্যতায় এখন পরিবর্তন আসায় বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো। অথচ এক সময় কিন্তু এমনটি ছিলনা। সে স্মৃতি বা ইতিহাসের দিকে দেখতে হলে খুব বেশী পেছনে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। সত্তর কিংবা আশির দশকেও ঢাকা মহানগরীর অবস্থা এমনটি ছিলনা।
আমরা একটু ভলোভাবে খেয়াল করলেই তা সহজেই স্মরণ করতে পারবো। আমরা যদি সে সময়কার বাংলা সিনেমাগুলি দেখি তাহলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেসময় এখনকার মতো এত আধুনিক মানসম্পন্ন রাস্তাঘাট না থাকলেও গাড়িঘোড়ার এত আধিক্য ছিলনা। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও ছিল একেবারেই হাতে গোনা। তখন টমটম ঘোড়ার গাড়ি কিংবা রিক্সায় চড়ে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা সহজেই ঘুরে বেড়ানো সম্ভব ছিল। আমরা আমাদের ছোটবেলাতে মফস্বল থেকে ঢাকা শহরে এসে তা দেখতে পেয়েছি। আমাদের বয়সের অন্যরাও স্মরণ করলেই তা সহজেই বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই। তাই বলে শহরের উন্নয়ন হবে না তা নয়। তবে সে উন্নয়ন হওয়া উচিত ছিল পরিকল্পনা মাফিক।
পরিকল্পিত নগরায়ন হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার অংশ, যা একবার একভাবে হয়ে গলে তা পুনরুদ্ধার বা সহজে সংস্কারযোগ্য নয়। কারণ ধরা যাক, একটি বিল্ডিং একটি ডিজাইনে একবার করা হয়ে গেল, তখন তা কমপক্ষে ১০০ বছরে পবির্তন করা সম্ভব নয়। এভাবেই ঢাকা মহানগর আস্তে আস্তে একটি অপরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকের পরে এসে ইস্টার্ন হাউজিং, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, সামরিক বাহিনীর ডিওএইচএস এবং সরকারিভাবে রাজউক কিংবা নিকুঞ্জ টাইপের পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। এভাবেই বর্তমানে কিছু এলাকার প্রাকৃতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে দেখা গেছে। এসব আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন এলাকার সৌন্দর্য আরো বেশি করে ফুটে ওঠে এ রকম কোনো ঈদের ছুটিতে। তখন রাস্তাঘাটে খুব সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করে। এবারের ঈদেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের ছুটিতে রাজধানীতে যাঁরা থেকে গেছেন, তাঁরা সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন এবং বলছেন রাজধানী ঢাকা শহর যদি সারা বছর এরকমই থাকত তাহলে কী মজাই না হতো!
এরই মধ্যে চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, শিশুমেলা, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, আহসান মঞ্জিল, মুক্তযুদ্ধের জাদুঘর মিরপুরের ও রায়ের বাজারের স্মৃতিসৌধ, আশুলিয়া, হাতিরঝিল চক্কর, বিভিন্ন পার্ক, গার্ডেন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, ফ্যান্টাসি কিংডম ইত্যাদি প্রত্যেকটি জায়গায় শিশুসহ মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ ঈদের সবচেয়ে বেশি আনন্দ করে তো শিশুরাই। এসব জায়গায় মানুষের ভিড় ও আগ্রহ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে মনেই হয় না যে ঈদের আগে গুলশানে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী জঙ্গি হামলা হয়েছে। তাদের অবাধ চলফেরা দেখে এমনটিও মনে হয়নি যে, ঈদের দিনে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী জঙ্গি হামলা হয়েছে। আর এমন মনে না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো বাঙালি উৎসবপ্রিয় এবং বীরের জাতি। অতীতেও বাঙালিকে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কিংবা পাকসেনাদের দ্বারা অতর্কিতে হামলা তাদেরকে স্বাভাবিকতা থেকে দমাতে পারেনি। কারণ সাময়িক ভীতি ছড়ালেও এসবের ভয়ে ভীত হয়ে মানুষ কিন্তু ঘরে বসে নেই। তারা তাদের মতো করেই এগিয়ে চলেছে।
শনিবার নয়দিনের লম্বা ছুটি শেষ হচ্ছে। রোববার থেকে আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে ঢাকা শহর। আবারও হয়ে উঠছে আগের মতো চিরচেনা রূপে। মাঝখানের এ কয়দিন শুধু স্মৃতির পাতায় স্বপ্ন হিসেবেই ধরা দেবে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনে। আবার ভিড়, গণপরিবহন সংকট, পরিবেশদূষণসহ নাগরিক সব অসুবিধাগুলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে দেখা দেবে। কেটে যাবে স্বপ্নের ঈদের আমেজ। স্মৃতি হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকবে আরো কোনো একটি ঈদের ছুটির জন্য।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়