সুন্দরবন
বনমোরগের রোস্ট, হরিণের ঝাল ফ্রাই আর বাঘের রেজালা!
জয়বায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ আজ অন্য যে কোনো দেশ থেকে নাজুক অবস্থানে। এর মধ্যে সুন্দরবনের মতো প্রকৃতিকন্যার ক্ষতি করে মাথাপিছু ৮ ওয়াট বিদ্যুতের কি আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন? ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে যদি এর চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয় তাহলে সেটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের চুক্তি শেষ হলো। মূলত এর মাধ্যমে ‘মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট’ প্রকল্পের কাজে আর তেমন প্রতিবন্ধকতা থাকল না।
অবস্থা এখন যে পর্যায়ে গেছে, অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবন ধ্বংস করে আবাসিক কোনো প্রকল্প তৈরি করলেও বোধহয় কোনো প্রতিবাদ কাজে আসবে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিদ্যুতের যত প্রয়োজন; ক্রমবর্ধমান এ জনসংখ্যার বাসস্থানের জন্যও তো বসবাসের জায়গা প্রয়োজন? দেশের প্রায় অঞ্চলে ঘনবসতি থাকলেও সুন্দরবনে কিছু বন্য প্রাণী, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ আর নৈসর্গিক প্রকৃতির বসবাস। এ চেয়ে ফাঁকা জায়গা কি আর আছে? ওখানেই তো বসতি স্থাপনের অন্যতম জায়গা। সরকারের গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিলে দেশের এক শ্রেণির মানুষ কিন্তু সত্যি সত্যি সেটাকে সাধুবাদ জানাবে। বিদেশে গিয়ে ভালো মানের ডুপ্লেক্স কেনার থেকে সেটাই কিনবে।
আর সুন্দরবনের মধ্যে আবাসিক এলাকা স্থাপনের পর কী হতে পারে? কেন, সকালবেলা বনমোরগের রোস্টের সঙ্গে রুটি দিয়ে নাশতা! দুপুরের খাবারে হরিণের ঝাল ফ্রাই আর রাতের ভোজন হবে বাঘের রেজালা দিয়ে! এটাও সত্য হতে পারে! এ রকম নির্দয় হওয়া এখন মনে হয় সময়ের ব্যাপার মাত্র! সুন্দরবন আমাদের কত বড় সম্পদ সেটা আমরা বুঝতে বোধহয় ব্যর্থ হলাম। খানিকটা অযাচিতভাবেই এর পাশে স্থাপন করতে চলেছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক নানা ক্ষতির দিকের মধ্যেও এর পরিবেশগত ক্ষতির দিকটা অনেক বেশি। আর এ জন্যই এখনো পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মহলসহ অনেকের এ ব্যাপারে চূড়ান্ত আপত্তি আছে। এ প্রকল্প এতদূর আগানোর পেছনে যে কারণ তা একান্ত সরকারের স্বদিচ্ছা! ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা মারাত্মক জলবায়ু বিপন্ন দেশের তালিকায় আমাদের দেশের অবস্থান ওপরের সারিতে হওয়ায়, আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে। আর এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা দেশের পরিবেশের কথা উপেক্ষা করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছি বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি করে। যেখানে ৭০ ভাগ টাকা সুদে কাজ করা হবে। আর চড়া মূল্যে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিদেশিদের কাছ থেকে কিনতে হবে।
কয়লা আমদানি করতে হবে ভারতের কাছ থেকে, যেখানে তারা চূড়ান্ত সুবিধা নেবে। আর সেই কয়লা বহন করা হবে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী দিয়ে। যদি তেলের মতো কোনো কয়লাবোঝাই জাহাজ ডুবে যায়? সেটার জন্য সুন্দরবনেরই ক্ষতি হবে। আর তা না হলেও এত এত জাহাজ যাতায়াতের ফলে সংশ্লিষ্ট নদীগুলোতে পড়বে মারাত্মক প্রভাব। কারণ ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কম হলেও বছরে সমুদ্রপথে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা আমদানি করা লাগবে। এসব ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার আমাদের; কিন্তু আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে সুবিধা লুটে নেবে অন্যরা।
এ জন্যই এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে। মূলত এর পরিবেশগত ক্ষতির কারণটি বিবেচনায় এনে। এ প্রকল্পটি দেশের ফুসফুস হিসেবে বিবেচিত সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করবে। এবং এ প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটির প্রতিবাদ তারাই করছে, যারা বিষয়টি বুঝেছে। এ প্রকল্প নিয়ে সরকার যেমন বলছে এটি ক্ষতির কোনো কারণ হবে না। অন্যদিকে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে গঠিত সুন্দরবন রক্ষার জাতীয় একটি কমিটি এর ব্যাপক বিরোধিতা করে চলেছে। তারা সবাই যথেষ্ট বিজ্ঞ ও চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে পরিচিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কেন বলছে এ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না? এ প্রশ্নে যথোপযুক্ত কোনো উত্তর না পাওয়া গেলেও যে দু-একটি কারণ পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম দেশকে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। কিন্তু অন্য কোথাও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যেত। কিংবা সুন্দরবনের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়েও এ বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে পারত। সম্প্রতি দেশের বিশিষ্টজনদের একটি প্রতিনিধিদল এ এলাকা ঘুরে এসেও সরকারকে আরেক দফা বোঝাতে ব্যর্থ হলো। এ কাজ আমাদের জন্য শুভ নয়। কয়লাভিত্তিক এ রকম কেন্দ্র ভারত নিজেদের দেশেও করতে আগ্রহী না হলেও আমাদের দেশের এ প্রকল্পে তাদের বিনিয়োগ থাকছে। যেখানে তারা কয়লা রপ্তানি ও বিদ্যুৎ বিক্রির মাধ্যমে বেশ সুবিধা আদায় করবে।
এ বিষয়ে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রীয় এক সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থানকালে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিলেন। সেখানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের একটি প্রস্তাবনা ছিল। সেই ভিত্তিতেই ২০১২ সালে বাংলাদেশের অধীন সুন্দরবনের নিকটবর্তী রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে (পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) চুক্তি স্বাক্ষর করে।
গত ২০ এপ্রিল ২০১৩ ঢাকায় ভারতের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। এরপর রামপালে না গিয়ে ২৫০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় মনমোহনের অনুপস্থিতিতে, হাসিনা ও মনমোহন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন এ প্রকল্প।
এতকিছু দেখার পর আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা দেখতে পাব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কপালে থাকলে সুন্দরবনের ভেতর আবাসিক এলাকা গড়ে উঠলে এ প্রকল্পের বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হবে সেখানকার ঘর! আর সেই আবাসিক এলাকায় সুন্দরবনের শুকনো কাঠে পুড়িয়ে বনমোরগের রোস্টের সঙ্গে রুটি দিয়ে সকালের নাশতা, হরিণের ঝাল ফ্রাই দিয়ে দুপুরের খাবার; আর রাতে আয়েশ করে ঘুমানোর আগে বাঘের রেজালা খাওয়া চলবে!
লেখক : সাংবাদিক।