আন্তর্জাতিক
কাশ্মীর সমস্যার মূল কোথায়?
পৃথিবীজুড়েই চলছে সংঘাত। সমস্ত সংঘাত আর অশান্তিকে একই তত্ত্বের আওতায় ব্যাখ্যা হয়তো করা যায়। তবে কিছু কিছু পরিস্থিতিকে একটু গভীরভাবে দেখা জরুরি। কাশ্মীর-সমস্যা তেমন। সীমিত মাত্রার সংঘাত (Low Intensity Conflict) হওয়ায় কাশ্মীর-সমস্যা ইদানীংকালে খুব একটা সামনে আসে না। অবশ্য গত ৮ জুলাই থেকে ফের খবরের শিরোনামে এসেছে কাশ্মীর।
গত কদিনের ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেল, ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর হাতে বুরহান ওয়ানি নামের এক সশস্ত্র বিদ্রোহীর মৃত্যু হয় দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রাল এলাকায়। আগের লেখায় বলেছিলাম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যুবকদের মধ্যে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন বুরহান। তিনি কাশ্মীরের ‘স্বাধীনতা’ আন্দোলনে একজন ‘আইকন’ হয়ে উঠেছিলেন। ফলে, তাঁর মৃত্যু গোটা ভ্যালিতে একটি ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। অন্যথায়, দু-চারজন সশস্ত্র বিদ্রোহীর মৃত্যু তো কাশ্মীরের নিয়মিত রুটিন। সাধারণত, সেখানে প্রতি মাসেই দু-চারজন সশস্ত্র যুবকের মৃত্যু হয় ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে। তাদের জানাজায় অনেক লোক অংশ নেয়। প্রতিবাদ হয়। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়। মাঝেমধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়াবাড়িতে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ নিহত হয়। কিংবা, একজন ‘বিদ্রোহীর’ সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে কারো সারা জীবনের সঞ্চয় করা সাজানো-গোছানো বাড়িটি সৈন্যদের হাতে বিস্ফোরিত হলে প্রতিবাদের মাত্রা বাড়ে।
দু-একদিনের হরতাল ঘোষণা হয় ভারতবিরোধী, স্বাধীনতাকামী এবং পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু। পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া জানায় নিয়মিত। দিল্লি তার গতানুগতিক জবাব দেয়। জাতিসংঘ বিবৃতিতে পরামর্শ দেয় দুই দেশকে আলোচনায় বসার। ভারতপন্থী রাজ্য নেতারা কেন্দ্রকে দোষারোপ করেন। এসব ওখানকার স্বাভাবিক জীবনের অংশ। একজন নৃবিজ্ঞানী একে বলেছিলেন, নিপীড়ন আর প্রতিবাদ এ দুয়ের রুটিনাইজেশন। চক্রাকারে একের পর এক আসতে থাকে। চলতে থাকে অনিঃশেষ। বুরহানের মৃত্যু এই চক্রটিকে একটু দীর্ঘায়িত করেছে।
প্রতিবাদের প্রতিদিনকার ভাষাটুকু একটু জোর পেয়েছে। সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১, ২, ৩ থেকে ১০, ২০, ৩০, ৪০ পেরিয়েছে। হরতালের মেয়াদ দু-তিনদিন থেকে ১০ দিনে এগিয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরের সমস্যাটি আসলে কোথায়? এবারও গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে, বুরহানের মৃত্যুর পর বিক্ষোভ, গুলি আর মৃত্যু ইত্যাদি হয়েছে। তাহলে বুরহান নামের এক যুবকের মৃত্যুই কি আসল সমস্যা? নিশ্চয়ই না। মূলত কাশ্মীরে সংঘটিত প্রতিটি মৃত্যু একেকবার পৃথিবীকে মনে করিয়ে দেয় যে কাশ্মীর একটি সমস্যা। আর এই সমস্যার মূল নিহিত আরো গভীরে।
অনেকেই মনে করেন, ভারত থেকে কাশ্মীরকে স্বাধীনতা দিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। যারা এই মতের পক্ষে তাঁরা ভারতকে মনে করেন ‘দখলদার’, তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র কিংবা নিরস্ত্র কাশ্মীরি ‘বিদ্রোহী’ কে মনে করেন ‘স্বাধীনতাসংগ্রামী’। বিপরীতক্রমে অনেকে বলেন যারা স্বাধীনতা চায়, তারা ভারতকে মেনে নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! ওই পক্ষের দৃষ্টিতে কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার দাবি হলো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বা রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাস। অনেকে আবার মধ্যবর্তী একটা সমাধান চান। তা হলো, কাশ্মীর ভারতের সঙ্গেই থাকুক। তবে তাকে বিশেষ ধরনের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হোক। যেমনটা এখনকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে। মূলত ন্যাশনাল কনফারেন্স বা পিডিপির মতো কাশ্মীরের ভারতমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর এটাই দাবি।
শেখ আবদুল্লাহ এমন স্বায়ত্তশাসনের আশাতেই নেহরুর সঙ্গে থাকতে রাজি হয়েছিলেন। তবে এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাস্তবে সেখানে সামান্যই কার্যকর। সংবিধানে থাকলেও এই বিশেষ স্বায়ত্তশাসনকে ক্রমান্বয়ে খর্ব করা হয়েছে বলে অনেকেরই অভিযোগ। সেদিক থেকে দেখলে মনে হয়, কাশ্মীরের মূল সমস্যা ভারতীয় রাষ্ট্রের ঐক্য বনাম ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’/‘স্বাধীনতাবাদ’। যদি সমস্যাটি তাই হতো তাহলে ‘স্বায়ত্তশাসন’ দুই পক্ষের জন্য ভালো সমাধান বটে। কিন্তু সমস্যার মূল যে আরো গভীরে!
বরাবর যে কাশ্মীর সমস্যার কথা বলা হয় সে কাশ্মীর আসলে শুধু কাশ্মীর নয়। কাশ্মীরের দাপ্তরিক নাম মূলত, ‘জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’। জম্মু, কাশ্মীর এবং লাদাখ তিনটি আলাদা চরিত্রের অঞ্চল যা উঁচু পাহাড় দিয়ে বিভক্ত। তিন এলাকার মানুষের স্বভাব ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, জলবায়ু ভিন্ন, ভাষাও ভিন্ন। মর্মান্তিক হলেও সত্য, এই তিনটি মিলে হয়েছে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর রাজ্য। লাদাখের নামটি রাজ্যের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ বাস করে কাশ্মীরে। আর স্বাধীনতার প্রশ্নটি ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয় সেখানেই। জম্মুবাসীরা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা বরাবরই রাজ্যটিকে শর্তহীনভাবে ভারতে যুক্ত করতে সক্রিয় ছিল। লাদাখিদের অনেকেই এখন চায় জম্মু-কাশ্মীর থেকে আলাদা হয়ে সরাসরি দিল্লির শাসন। রাজ্যের জনমনের এই অদ্ভুত বৈচিত্র্যই ভারতীয়দের সবচেয়ে বড় যুক্তি কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। জটিলতার জট খুলতে হলে যে প্রশ্নটি আসে তা হলো, এতটা বৈচিত্র্যময় রাজ্যটি কেনই বা গঠিত হয়েছিল? রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪৬ সালে। লাহোরের শিখ সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর অমৃতসরে এক চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের সহযোগিতার পুরস্কার স্বরূপ জম্মুর গভর্নর গুলাব সিংহকে বেশ কিছু এলাকা হস্তান্তর করা হয়। সেই সূত্রেই জম্মুর হিন্দু মহারাজা গুলাব সিংহ অধিকার পান কাশ্মীরের। চুক্তি অনুসারে, ব্রিটিশ সরকার যে কোনো বহিঃস্থ আক্রমণে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় মহারাজাকে। আর অভ্যন্তরীণ শাসন ও রাজস্ব আদায়সহ সব বিষয়ে তিনি পান স্বাধীনতা। বিনিময়ে মহারাজা ব্রিটিশদের দেন ৭৫ লাখ রুপি আর কিছু বার্ষিক নজরানা। তারপর পূর্ণ ১০০ বছর কাশ্মীর শাসন করে ডোগরা জমিদারের পরিবার। ব্রিটিশরা যখন উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এমন (অভ্যন্তরীণভাবে স্বাধীন) মহারাজা ছিল ৫৬২ জন। তাদের অধীনে ছিল একেকটি প্রিন্সলি স্টেট। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ছিল বৃহত্তম।
দেশভাগের সময় শর্ত ছিল, এসব প্রিন্সলি স্টেট ভারত অথবা পাকিস্তানের যে কোনো একটিতে যোগ দেবে। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর, জুনগড় এবং হায়দরাবাদ ছাড়া সব ছোট ছোট প্রিন্সলি স্টেটের রাজা কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেন। এই তিনটি রাজ্যের প্রধানরা ‘স্বাধীন’ থাকার চেষ্টা চালান। তাঁরা নানাভাবে নেহরু ও জিন্নাহর সঙ্গে দেন-দরবার করছিলেন। হায়দরাবাদ ও জুনগড়ের রাজা মুসলমান ছিলেন। কিন্তু রাজ্য দুটির অবস্থান ছিল ভারতের ভেতরে। সংখ্যার বিচারে হিন্দু জনসংখ্যাও ছিল খানিকটা বেশি। ফলে সেখানে পাকিস্তানি প্রভাব খাটেনি। বরং ভারতের মধ্যেই বিলীন হয়েছে জুনগড় ও হায়দরাবাদ। পক্ষান্তরে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের জনসংখ্যা ছিল মুসলিম (৮৫%), রাজা ছিলেন হিন্দু, অবস্থান ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যখানে। রাজ্যটির ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল অসীম। কাশ্মীর সমস্যার মূল নিহিত সেখানেই।
এ কারণেই কাশ্মীরের এক সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন, ‘উই লিভ ইন পাস্ট। আওয়ার প্রবলেমস আর দ্য পাস্ট। দেয়ার ইজ নো ওয়ে টু দ্য ফিউচার।’ কাশ্মীর পেলে ভারতের পক্ষে রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তানসহ গোটা আরব বিশ্বে যোগাযোগের সুযোগ হতো পাকিস্তানের ভূ-খণ্ড এড়িয়ে। আবার কাশ্মীর পেলে চীনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে পাকিস্তান। পাশাপাশি, কাশ্মীর হলো পাকিস্তানের ওয়াটার টাওয়ার। পাকিস্তানের সব নদীর উৎস কাশ্মীর। এসব গুরুত্ব নেহরু আর জিন্নাহর অজানা ছিল না। ফলে কাশ্মীরকে কব্জা করতে ভারত ও পাকিস্তান প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু করে।
দুটি দেশই গুরুত্ব দিয়েছে জনগণের চেয়ে জমিনকে। ফলে যে কোনো উপায়ে দখলই ছিল তাদের মূল আগ্রহ। যেদিন এই দেশ দুটি একসঙ্গে হয়ে জনগণকে গুরুত্ব দিতে পারবে, সেদিনই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে। এই বোধোদয় জরুরি যে যত দিন যায়, সমস্যা তত গভীর হয়। সংঘাতের হিসাব তত জটিল হয়। প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, ক্ষোভের বীজগুলো তত বিষাক্ত হয়। সমাধান তত কঠিন হয়। ১৮৪৬ থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক ভুলগুলোর একটা একটা করে সমাধান এত সহজে সম্ভব নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক