আন্তর্জাতিক
তুরস্কের আকস্মিক অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রের বিজয়
আদতে তুরস্ক সশস্ত্র বাহিনীর একাংশের এই অভ্যুর্থান আকস্মিক কিছু নয়। এর আগেও তারা পাঁচ বার ক্যু করেছিল। হালে ২০১৬ সালে তারা ষষ্ঠবারের ক্যু করলো। কিন্তু এই যাত্রায় ক্যু ভেস্তে গেলো, তাও আবার আমজনতার প্রতিরোধের মুখে। এটা ভবিষ্যতে, বলতে গেলে, সারা জনমের জন্যে গোটা বিশ্ববাসির কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।
এরদোয়ানের একে পার্টি ক্ষমতায় এসেছিলো ২০০২ সালে I এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রী হন ২০০৩ সালে। তারপর ২০১৪ সালে তিনি হয়ে যান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। ২০০২ থেকে ২০১৬ এই ১৪ বছর এমন কি হয়ে গেলো যে তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনীকে ক্যু করতে হবে ? ১৯৬০ সালের ক্যু , ১৯৭১ সালের টার্কি মিলিটারি মেমোরেন্ডাম , ১৯৮০ সালের ক্যু , ১৯৯৩ সালের ক্যু এবং ১৯৯৭ সালের টার্কি মিলিটারি মেমোরেন্ডাম , সবই ছিল মিলিটারির পক্ষে। আর ঐ সব ক্যুয়ের সফলতার পিছনে একটিই কারণ ছিল , তা হল জনগণের সাপোর্ট। আর সঙ্গত কারণে ২০১৬ সালের ক্যু অসফল হওয়ার পিছনেও একটিই কারণ , জনগণের সাপোর্ট ছিলোনা এই ক্যুতে। নিদেনপক্ষে ৫০ শতাংশ জনগণ এরদোয়ানকে সাপোর্ট দিয়েছে, বাকি লোক এটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছে। এরদোয়ান সরকারের উপর তারা খুশি ছিল। ২০০৯ সালে এরদোয়ান পিকেকে ইস্যু হাতে নিয়ে তা অনেকটা শান্ত করেছেন।
মানবাধিকারের বিষয়ে এসে তিনি ১৯৯১ সালে প্রবর্তিত ‘এন্টি-টেরর ল’ শিথিল করেছেন , মাইনোরিটি এবং জাতিগত অধিকার সমুন্নত রাখার কাজ হাতে নিয়েছেন। তার সরকার খৃষ্টান এবং ইহুদি সংখ্যালঘুদের তাদের হারানো সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যা ১৯৩০ সালে তৎকালীন তুরস্কের সরকার তাদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলো। এতো কিছুর পরও তুরস্ক ইইউ’র সদস্য হতে পারেনি। কারণ হল ফ্রিডম অফ প্রেস এবং মদ বিক্রি ও খাওয়ার উপর বিধিনিষেধ আরোপ। মদ খাওয়ার বিধিনিষেধ আরোপের ফলে সশস্ত্র বাহিনী অনেকটা নাখোশ হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ১৯৮৯-১৯৯০ সালে ৭ মাসের জন্যে আমরা কয়েকজন অফিসার উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে তুরস্কে গমন করি। তখন দেখেছি তুরস্কের রাস্তায় রাস্তায় মদের দোকান আর মোড়ে মোড়ে টপলেস বার। এসবই ছিল আধুনিক তুরস্কের পরিচায়ক। কামাল আতাতুর্ক ছিলেন আধুনিক তুরস্কের জনক। তার বহির্দেশে নীতি ছিল ‘লুক টু দি ওয়েস্ট’ ধারণার উপর প্রবর্তিত। তিনি ভাষা পরিবর্তন করেছিলেন পশ্চিমাদের খুশি করার জন্যে। ইইউ’র সদস্য হবার জন্যে কি না করেছে তুরস্ক। তুরুস্কের মাত্র ৫ শতাংশ ভূমি ইউরোপে অবস্থিত। তাতেই তারা নিজেদের ইউরোপিয়ান বলে পরিচয় দেয়। ইউরোপের সকল ইভেন্টে তারা অংশ নেয়।
তারা মুসলিম রাষ্ট্র হয়েও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। এতো কিছু করার পরও তারা ইইউ’র অংশ হতে পারেনি। সুতরাং এরদোয়ানের ইসলামিক ধাঁচের সরকার যে পশ্চিমা ও ইউরোপিয়ানদের পছন্দের ছিল না তার প্রমান এই ক্যু।
পর পর দুই বার ক্ষমতায় আসার ফলে এরদোয়ান সরকার পশ্চিমাদের গুড বুকে ছিল না। তারা হিজাবের প্রবর্তন করেছে। ইতিমধ্যে আইএস নামে নতুন এক সন্ত্রাসী গ্রুপের উদ্ভব হয়েছে। সবাই বলাবলি করছে আইএস আমেরিকা ও ইসরায়েলের সৃষ্টি। সুতরাং যে কোন সময় রাশিয়া, সিরিয়া ও ইরানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আইএস নিধনে লিপ্ত হতে পারে তুরস্ক। এটা পশ্চিমাদের মাথা ব্যথার কারণ। তাই এই হঠাৎ ক্যুতে তাদের ইন্ধন আছে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে।
আধুনিক তুরস্কের আধুনিক সেনা বাহিনী যথেষ্ট ব্যালান্সড কিনা তা বলার অবকাশ রাখে I সম্মানিত পাঠক হয়তো জানেন তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের আমল থেকেই ‘বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস’ প্রচলিত। অফিসার এবং নন-কমিশনড অফিসার ব্যতিত বাকি সব সৈনিকই হল ‘কনস্ক্রিপ্ট’ I ফলে বর্তমান যুগে তাদের ‘ডি-মোটিভেটেড’ থাকার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। তারা প্রায় বিনা বেতনে চাকরি করে। একজন কনস্ক্রিপ্ট মাসে যে বেতন পায় তা এক প্যাকেট সিগারেটের মূল্যের সমতূল্য। সুতরাং এটা এমন একটা ব্যাপার যার ফলে তাদের মাঝে আদেশ এবং নিয়ন্ত্রণ , প্রশিক্ষণ, মনোবল এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমের ঘাটতি থাকতে পারে। অফিসাররা হতে পারেন উচ্চাভিলাষী। গত ৬ বারের ক্যু তাই প্রমাণ করে।
ইস্তানবুলের বাহচিজার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান গলনর আইবেট বিবিসিকে বলেছেন, ‘তিনটি কারণে এই সেনা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রথমত অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক সেনা এই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়। দ্বিতীয়ত উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা স্পষ্ট ভাষায় এই হামলার নিন্দা করেছেন। সবশেষ কারণ হলো সাধারন জনগণ এই অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন।’
তুরুস্কের এই ক্যুয়ের মাস্টারমাইন্ড হতে পারেন ফেতুল্লা গুল। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। যুক্তরাষ্ট্র সহজেই তাকে দেশে ফেরত পাঠাবে না বলে মনে হচ্ছে। ফলে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এতে মধ্যপ্রাচ্য অন্য মেরুতে পৌঁছে যাবে। ইরান, সিরিয়া, তুরুস্ক এবং রাশিয়া মিলে নতুন মেরুকরণ হতে পারে, যা পশ্চিমা শক্তির জন্যে হবে এক বিব্রতকর বিষয়।
এখন এরদোয়ানের অনেক চ্যালেঞ্জ, তা হতে পারে (১) মৃত্যুদণ্ডের বিধান পুনরায় চালুকরন , যা ইইউ’র সদস্য পদ পেতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, (২) ফেতুল্লাহ গুলকে দেশে ফেরত আনা, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে (৩) আর্মড ফোর্সেস উপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ। এই ক্যু শুধুমাত্র বিমান বাহিনী এবং জেন্দেরমা নামে একটি পেরা-মিলিটারি অংশগ্রহণ করেছিল। ভবিষ্যতে কনস্ক্রিপ্ট প্রথা থাকবে, নাকি একটি আধুনিক স্ট্যান্ডিং আর্মি থাকবে তা বিবেচনায় নিয়ে আসা, (৪) ইসলামিক স্টেট নিয়ে নতুন চিন্তা, (৫) কট্টর ইসলামিক ভাবধারা থেকে নিজের দলকে দূরে রাখা (৬) পিকেকে ইস্যু, (৭) ইরান , সিরিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি।
এই ক্যুয়ের ফলে তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে গেছে। তাদের অতীতের ন্যায় বীরের বেশে জনগণের সামনে আসতে সময় লাগবে। তুরস্কের স্বাধীনতার যুদ্বে তাদের অবদান এ জাতি কখনো ভুলতে পারেনা। কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্বে প্রায় ৩৭ হাজার সৈন্য জীবন দিয়েছিলো। একসময় তাদের রক্তে আকাশের চাঁদ প্রতিবিম্ব হয়ে ধরা দেয়, আর পরে তা রূপান্তরিত হয়ে যায় তুরস্কের জাতীয় পতাকায়। সশস্ত্র বাহিনীর এ মনোবল ফিরিয়ে আনা হবে এরদোয়ান সরকারের প্রধান কাজ। ঐতিহাসিক গালিপলির যুদ্বে কামাল আতাতুর্ক অবরুদ্ব সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের যুদ্ব করার আদেশ দিচ্ছিনা, আমি তোমাদের যুদ্ব করে মৃত্যু বরণের আদেশ দিচ্ছি, তোমাদের মরার আগেই অন্যান্য সৈন্য ও অধিনায়করা তোমাদের জায়গা পূরণ করে নিবে।’
শুধু সেনাবহিনী নয় এই ক্যুয়ের ফলে সিভিল সমাজেরও মনোবল ভেঙ্গে গেছে। এর ফলে হাজার হাজার বিচারপতি, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, শিক্ষক, এমন কি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের লোকেরাও চাকরী হারিয়েছেন। স্রেফ বিরোধী দলের লোক, এমন অজুহাতে চাকুরী গেছে। এতসব লোকের বিচার করা আরো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।
এরদোয়ান সরকারের বিরোধী দল নিধনের অভিযোগও উঠেছে। ক্যুয়ের উছিলায় এরদোয়ান বিরোধী পক্ষের অনেককে সরিয়ে দেয়া হবে এমন কথাও বলেছেন অনেক দেশ। ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়বে রাজনীতি এবং অর্থিনীতির উপর, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই ক্যু তুরস্কের একটি প্রধান অর্থনৈতিক খাত পর্যটন খাতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
ক্যু সফল হয়নি। আপাতত শান্ত হয়েছে সব। এরদোয়ান সরকারের এখন অনেক কাজ করা বাকি। সর্বস্তরে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আনয়ন হল প্রথম পদক্ষেপ। যেহেতু এই ক্যুতে সামরিক এবং অসামরিক এই উভয় শ্রেণীর লোকেদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গিয়েছে, তাদের মাঝে স্থিতিশীলতা আনয়ন একটি ব্যাপক পদক্ষেপ। এই ক্ষেত্রে যেকোন হার্ডলাইন পদক্ষেপ বুমেরাং হতে পারে। এখন রাজনৈতিক সমঝোতা সময়ের দাবি। বিরোধী দল, সুশীল সমাজ এবং সর্বস্তরের জনগণকে সাথে নিয়েই ঐতিহাসিক এই মহাসংকট মোকাবিলা করতে হবে এরদোয়ানদের। মনে রাখা উচিত এই সংকট এরদোয়ানের দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ, তথা তার লিডারশিপের উপর এবং তার একে পার্টির উপর এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন একে দিয়েছে। তুরস্কের এই বিজয় ছিল জনগণের বিজয়, এটা প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রকৃত বিজয়। আমাদের এ ঘটনা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
লেখক : মেজর, পিএসসি,জি (অব:), বর্তমানে আর্মি ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, সিলেটে কর্মরত।