শিক্ষা
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় কেন অনীহা?
চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে আট লাখ ৯৯ হাজার ১৫০ শিক্ষার্থী। এ সংখ্যার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে যোগ হবে গতবারের অবশিষ্ট কিছু ভর্তি-ইচ্ছুক। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখের মতো শিক্ষার্থী এবারের ভর্তিযুদ্ধে নামবে। এবার জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ২৭৬ শিক্ষার্থী। ৩৮টি পাবলিক ও ৮৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে স্নাতক (পাস/সম্মান) শ্রেণিতে মোট আসন আট লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬টি। সে হিসেবে এবারের ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ বিদেশে পড়তে গেলেও দেশের অনেক শিক্ষার্থীই কোথাও ভর্তি হতে পারবে না।
অথচ এবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাত্র ২৮টি নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। যেখানে গতবারের তুলনায় অতিরিক্ত সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, এ দেশের উচ্চশিক্ষার কী অবস্থা! যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিট রীতিমতো সোনার হরিণ, সেখানে মানসম্মত শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অনেক পরের কথা। গোড়াতেই যে মহা গলদ! একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভিন্ন ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতি। যে কারণে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা, সময় ও শ্রম। ভ্রমণের ক্লান্তি আর মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে যোগ হয় নানা হয়রানি। তাহলে অনেক পরীক্ষা না নিয়ে কেন একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় না?
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে নেওয়া হয়, তবে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নয়, মেডিকেল কলেজে। সংগত কারণেই এটা আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে। যেখানে সব উপাচার্য চাইলেই এমনটা করতে পারেন, কিন্তু কেন করছেন না? নানাবিধ জটিলতা আর সমস্যার মধ্যেও এ ব্যাপারে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তা নয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০১৩-১৪ সেশনে একটি উদ্যোগ প্রায় সফলতার মুখ দেখেও আর দেখিনি! আঞ্চলিকতার খোঁড়া অজুহাতের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক কারণে এ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এ নিয়ে আর তেমন নাড়াচাড়া দেওয়া হয়নি। যদিও এর আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সমন্বয়ে গঠিত উপাচার্য পরিষদে বড় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সবাই একমত হয় একটি অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নের ব্যাপারে।
মূলত একই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি প্রশ্নপত্রে একই দিনে একযোগে পরীক্ষা নেওয়ার সময়ে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আর অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি সামনে চলে আসে। শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আর অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আর্থিক লাভের কাছে। আবেদন ফরম, খাতা ও পরিদর্শন ফি বাবদ যত টাকা খরচ হয়, তার কয়েক গুণ বেশি টাকা ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রেখে তা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তা করে না।
টাকা-পয়সার বিষয়টি ছাড়া আরো কিছু টেকনিক্যাল কারণ যে বিবেচ্য নয়, সেটা বলা ভুল। তবে অন্য যে বিষয়গুলো আছে, চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সেটা সমাধানে চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তাতে কারো মাথাব্যথা নেই। সাময়িক সমস্যাগুলোর কাছে বাস্তবমুখী এ সমস্যা আজ অসহায় হয়ে আছে। ফলে একই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গুচ্ছ পদ্ধতিতে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকেও কোনো স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়কে এ ব্যাপারে খোলামেলা বলতে দেখা গেছে, বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বিষয়টা চায় না, ছোটগুলো রাজি।
আগে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় পৃথক পরীক্ষা হলেও তেমন একটা সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, পাশাপাশি ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এরই মধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখও ঘোষণা করেছে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ। এখানে আগের মতোই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো যদি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে ফলের ভিত্তিতে কে কোন মেডিকেলে পড়বেন, তা ঠিক করে দিতে পারে, তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন তা পারে না? সমস্যা কোথায়? অভিজ্ঞ লোকবল আর টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞের যে প্রয়োজনীয়তা এখানে আছে, তা পূরণ করার মতো ক্ষমতা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আছে। ইউজিসির উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় বেশ আগে। তা আজ খানিকটা মুখ থুবড়ে আছে। মূলত সদিচ্ছার অভাব আমাদের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য বড় বাধা।
ভর্তি-বাণিজ্য আর কোচিং-গাইড বাণিজ্যের জন্যই অনেকে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করতে পারে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে এ ধরনের ব্যবসায় বড় ধস নামবে। সামান্য কিছু আয়ের বিষয় বাদ দিয়ে এবং ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের সীমাহীন দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। এতে সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। আর এ জন্য সবার আগে যেটা প্রয়োজন, তা আর বিশেষ কিছু নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক সহযোগিতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা।
তা না হলে উচ্চশিক্ষার ভুবনে প্রবেশে অধীর আগ্রহে থাকা শিক্ষার্থীকে এখন ভর্তি পরীক্ষা নামক মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে আরামের ঘুম হারাম করে আর সব কাজ বন্ধ করে, মানসিক চাপ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হবে। অভিভাবকদের পোহাতে হবে ভোগান্তি, করতে হবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের কাছে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী আর তাঁদের অভিভাবকদের কষ্ট, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ও দুর্ভোগের চেয়ে ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে পাওয়া আয়ের বিষয়টি যেন বড় হয়ে দেখা না দেয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।