আন্তর্জাতিক
কাশ্মীর যেন এক ফিলিস্তিন
যদিও কাশ্মীর শব্দের অর্থ ‘শুষ্ক ভূমি’ কিন্তু একালে কাশ্মীরকে বলা হয় পৃথিবীর ‘ভূ-স্বর্গ’I সপ্তদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরকে এ নামটি দিয়েছিলেন স্বয়ং মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীর। জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরে অবস্থিত ডাল হ্রদে একটি বজরায় শুয়ে তিনি কবিতার ভাষায় বলেছিলেন ‘গর্ ফিরদাউস, রূহে জামিন আস্ত, হামিন আস্ত , হামিন আস্ত , হামিন আস্ত,’ যার অর্থ হলো ‘পৃথিবীতে যদি কোনো স্বর্গ থেকে থাকে তা হলে এটা এখানেই আছে।’ এখন প্রশ্ন হলো ৩০০ বছরের মাথায় এসে এই বিংশ শতাব্দীতে কী কারণে ভূ-স্বর্গ নামক স্থানটি ভূ-নরকে পরিণত হয়েছে তা ভেবে দেখার বিষয় বৈকি। কী কারণেই বা পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তান নামক দুটি আধিপত্যবাদী দেশ তাদের নগ্ন থাবা এই ভূ-স্বর্গের ওপর বিস্তার করেছে তাও দেখার মতো বিষয় বৈ কি।
সর্বশেষ খবর হলো কাশ্মীর এখন উত্তাল। গত ৮ জুলাই ২০১৬ তারিখে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর সূত্রপাত হওয়া সহিংস ঘটনায় এই পর্যন্ত ৬০ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো চার হাজার ৫০০ জন। কাশ্মীরের এই নিপীড়ত জনতার দাবি মাত্র তিনটি : (১) কাশ্মীর উপত্যকার অসামরিকীকরণ (২) ১৯৯০ সালে কাশ্মীরে আরোপিত আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল অ্যাক্ট রহিত করণ এবং (৩) কাশ্মীরের স্বাধীনতা/স্বায়ত্তশাসন /আত্মনিয়ন্ত্রণ।
অতীতে ১৯৪৭ সালের পূর্বে এই পাক-ভারত উপমহাদেশ যখন এক ছিল তখন বিশেষ কোনো অঞ্চলের আধিপত্য নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা যায়নি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে ইংরেজদের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল “নীতির পরিণতি আজকের কাশ্মীরের লাইন অব কন্ট্রোল কিংবা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং খোদ ভারতেই সাত বোন রাষ্ট্রসহ প্রায় ৩০টি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের আবির্ভাব। মূল কথা হলো ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্যই এতদঞ্চলে এসব অস্থিরতা, উত্তেজনা ও বিভাজনের সংস্কৃতি বিদ্যমান।
নিছক দ্বিজাতিতত্ত্ব ধারণার ওপর ভিত্তি করে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি রাষ্ট্রের জন্মের পর অনেকটা উপজাত সমস্যা হিসাবেই কাশ্মীর সমস্যা শুরু হয়েছে। ১৯৪৭ সালে এই দুটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা লগ্নে পাক-ভারত উপমহাদেশে সর্বমোট ৫৬৫টি নৃপতিতুল্য রাষ্ট্র ছিল। তন্মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর অন্যতম। ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাক্ষরিত সংযুক্তিকরণ চুক্তির ভিত্তিতে পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর করদ রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে দাবি করে। তার বেশির ভাগ মুসলিম জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মীর দাবি করে, অপর পক্ষে চীন শাকসাম উপত্যকা ও আকসাই চীন নিজেদের দাবি করে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯-এ অন্তত তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া, ১৯৮৪ সালের পর থেকে সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই দেশ বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে জড়িত হয়েছিল। ভারত সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটি তাদের বলে দাবি করে এবং যার মধ্যে ২০১০ সালের হিসাবে, জম্মু বেশির ভাগ অংশ, কাশ্মীর উপত্যকা, লাডাখ এবং সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে প্রায় ৪৩% অঞ্চল শাসন করছে। পাকিস্তান এই দাবির বিরোধিতা করে, যারা প্রায় কাশ্মীরের ৩৭% নিয়ন্ত্রণ করে- এর মধ্যে আছে আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট বাল্টিস্থানের উত্তরাঞ্চল। অথচ কোনো দেশই কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে নেই। অন্যদিকে কোনো পরাশক্তি কিংবা খোদ জাতিসংঘ কেউই কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করেনি। আর তাই কাশ্মীরি জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কোনো সুফল নিয়ে আসেনি। এটা অনেকটা তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হতে বাধ্য করেছে। ফলে আত্মপ্রকাশ করেছে ৭টির মতো সংগঠন। তাদের সশস্ত্র আন্দোলনকে প্রতিহত করতে মাঠে নেমেছে ভারতীয় বাহিনী আর প্রতিনিয়ত রয়েছে পাকিস্তানি ও ভারতীয় বাহিনীর বিক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষ। সব মিলে কাশ্মীর এখন একটি ভূ-নরকের নাম।
লক্ষ্য করুন, প্রথম জাতিসংঘ মিশন ছিল ১৯৪৮ সালে প্রবর্তিত ইউএনটিএসও, যার প্রধান কাজ ছিল আরব-ইস্রাইল যুদ্ধবিরতি মনিটর করা। তার মাত্র এক বছরের মাথায় ২৪ জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় মিশন ছিল ১৯৪৭ সালে সংগঠিত জাতিসংঘ মিশন, যার কাজ হলো কাশ্মীর যুদ্ধের যুদ্ধবিরতি মনিটর করা। ১৯৭১ সালেও এটা ছিল, এখনো আছে। কিন্তু আসলে তারা কী করছে সেটাই জানার মতো বিষয়।
কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় এখন আন্তর্জাতিক কতৃপক্ষের কার্যকরী সম্পৃক্ততা। কাশ্মীরে চলমান সহিংসতায় গত দুই দশকে প্রায় এক লক্ষ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে আরো কয়েক হাজার, নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ১০ হাজারের মতো নাগরিক। গত কয়েক মাসে কাশ্মীরে ১৩ লাখ ছররা গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব কিছুই বিশ্ব নেতাদের টনক নড়াতে পারেনি। কিন্তু দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার দেশ পূর্ব তিমুরের কথাই ধরুন। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ সুদানের কথাই বলুন। এই দেশও ২০১১ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্ম প্রকাশ করেছে। যত সমস্যা শুধু কাশ্মীর কিংবা ফিলিস্তিনের বেলায়।
কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান এখন সময়ের দাবি। সমাধানের জন্য পদক্ষেপ হতে পারে (১) চলমান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে বহুজাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা। (২) জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের আয়োজন করে কাশ্মীরের জনগণের হাতে তাদের ভাগ্যকে ছেড়ে দেওয়া।
কাশ্মীরের জনগণকে এ কথা বুঝতে হবে পাকিস্তান কিংবা ভারত, কারো তোষামোদ করার প্রয়োজন তাদের নেই। এখন একতাবদ্ধ হয়ে সমাধানের পথে হাঁটাই হবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। কাশ্মীরের মতো একটি ছোট্ট একটি অঞ্চলে সাতটির মতো রাজনৈতিক দল, যার বেশির ভাগই উগ্রপন্থী। বৃহত্তর স্বার্থে উগ্রপন্থাকে পরিহার করে রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
লেখক : মেজর, পিএসসিজি ( অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিসনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত।