আন্তর্জাতিক
কেন জন কেরি দক্ষিণ এশিয়া সফর করলেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আমাদের দেশ সফরে আসেন, তখনই আমার ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা যখন মরিয়া হয়ে স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর তখন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নেয়। সে কী উৎকণ্ঠা, না জানি আরো কত বছর লাগবে দেশ শত্রুমুক্ত করতে। এত অত্যাচার, এত মৃত্যু, এত গণহত্যা—কোনো কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের টনক নড়াতে পারেনি।
১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রচেষ্টা চালায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে সপ্তম নৌবহরের বেশির ভাগ জাহাজ ভিয়েতনামের কাছাকাছি ছিল। ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিতে আদেশ দেন। ১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের ১০টি জাহাজ নিয়ে 'টাস্কফোর্স ৭৪' গঠন করা হয়। ১০ ডিসেম্বর এই নৌবহর মালাক্কা প্রণালিতে অবস্থান নেয়। ১১ ডিসেম্বর রাশিয়ার ওয়াশিংটন প্রতিনিধিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সাবধান করে দিয়ে বলেন, 'আগামীকাল ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করাতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।' জাহাজগুলো ১৪ ডিসেম্বর মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করে, বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। এই সময় ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এইএনএস ভিক্রান্ত বঙ্গোপসাগরে নেভাল ব্লকেড দিয়ে রেখেছিল।
১৫ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধজাহাজ নিয়োগ করে। এই দিন ২০টি সোভিয়েত রণতরী ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এর পর সপ্তম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে এবং এই নৌবহরকে ফিরিয়ে নেয়।
জন কেরি হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬৮তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে কেরি নৌ রিজার্ভ তালিকাভুক্ত হন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ঢাকার কর্মসূচি শুরু করেন। সেখানে পরিদর্শন বইতে লিখে জন কেরি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি সেখানে লিখেছেন, ‘আজ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথে তারই কন্যার দৃঢ় নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে।’ একাত্তরে বাংলাদেশ ‘হত্যাকারীদের আক্রমণের শিকার’ হয়েছিল উল্লেখ করে নিজের পাশে থাকার কথাও বলেন জন কেরি। তিনি বলেন, ‘একাত্তরকে ঘিরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আমি গর্বিত, আমি ওই যুদ্ধের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনমতের সঙ্গে ছিলাম।’ অথচ দেখুন ৩০ অক্টোবর ১৯৭৪ সাল, বুধবার বাংলাদেশ সফরে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, এর আগে ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন্স গ্রুপ (WSAG) বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনার সময়ও কিসিঞ্জার স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশকে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি এটার প্রমাণ স্বচক্ষে দেখার জন্য নাকি এসেছিলেন।
তবে কেরির মন্তব্যে আমাদের এত পুলকিত হওয়ার কিছু নেই, কেননা তিনি আবার এ কথাও বলেছেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলা ছিল বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। এই সন্ত্রাসবাদ দমনের মতো কঠিন সময়ে গণতন্ত্রই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সন্ত্রাস দমনে সুশাসন জরুরি।’ অর্থাৎ আমেরিকানদের কথা দ্রুতই ওঠানামা করে। তার প্রধান কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি রাজনীতিবিদরা নিয়ন্ত্রণ করে না, এটা নিয়ন্ত্রণ করে সিআইএ।
এবার ভারতের কথাই আসা যাক। ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ভারতের নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সম্পর্কই ছিল। কিন্তু বাদ সাধে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানিজশন চুক্তি। এদিকে, ভারত মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্কের মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কৌশলগত ও সামরিক সম্পর্ক করে বসে। আর তার ফল ১৯৭১ সালের সপ্তম নৌবহর মোতায়েন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গত ২৯ আগস্ট, সোমবার সন্ধ্যায় দ্বিতীয় ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সংলাপে অংশগ্রহণের জন্য নয়াদিল্লি অবতরণ করেন। এখানে তিনি পাঁচটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করেছেন। এগুলো হলো—১. দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের স্পেকট্রাম বা বর্ণচ্ছটা; ২. উভয় পক্ষের মাঝে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এবং স্মার্ট শহর প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য রোডম্যাপ; ৩. দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়, ভিসা, উদ্ভাবন ও বাণিজ্যিক প্রসার; ৪. দ্বিমুখী বাণিজ্য। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো ৫. কেরি এমন একসময় সফর করলেন, যখন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ প্রতিরক্ষা চুক্তি ‘লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ স্মারকলিপি’ (LEMOA) স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে তাদের সেনাবাহিনীর সরঞ্জাম মেরামতের জন্য একে অপরের সম্পদ এবং ঘাঁটি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। এই চুক্তি মেরামত এবং সামরিক সরঞ্জাম মেরামত ও সরবরাহ পরিপূরণ করতে সহায়তা করবে। এসব সামরিক কর্মকাণ্ড যৌথ অপারেশনে কাজে লাগবে।
এত সব কাজের একটিই উদ্দেশ্যে, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পর বাংলাদেশ ও ভারত অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং চীন ও উত্তর কোরিয়ার ওপর আধিপত্য বিস্তার। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে। তারা একাধারে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্যদিকে কৌশলগত অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ ছিল কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। বর্তমানে তাদের মাঝে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, জঙ্গি ও পারমাণবিক বিস্তার রোধকরণ ইত্যাদি বিষয়ে সুসম্পর্ক রয়েছে।
চীন যদি হাতে আসে আর থাকবে উত্তর কোরিয়া। আপাতত তাদের দিকেই নজর বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হবে সতর্কের সম্পর্ক। আমরা সব দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে চাই। ইউএস অ্যাম্বাসাডর ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেছিলেন, কিসিঞ্জারের দেওয়া বটমলেস বাস্কেট ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। কিসিঞ্জার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি এমন কথা বলেছেন সেটা তার মনে নেই আর। পরে বলেন, ‘এটা ছিল ১৯৭৪ সালের কথা, এখনকার কথা নয়।’
লেখক : মেজর (অব.) পিএসসি, জি, আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিট্রেশনে কর্মরত।