ফিরে দেখা
সেই গ্রাম এই গ্রাম
ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। বাড়ি মানে আমার টাঙ্গাইলের গোপালপুরে সেই চিরচেনা গাঢ় সবুজ গ্রামে, গাঁয়ে। অজপাড়া গাঁ বলতে যা বোঝায়, আমাদের গ্রামটিও তাই। আমি আমাদের এই গ্রামটিকে বলি পৃথিবীর সর্বশেষ গ্রাম। কারণ উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এই গ্রামে গিয়েই পুবের শহর থেকে আসা রাস্তাটি শেষ হয়ে গেছে। এরপর পশ্চিমে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই।
দীর্ঘ দেড় বছর পর এবার সেই গ্রামে গিয়ে দেখলাম, এই সময়টুকুর মধ্যেই অনেক কিছুই একেবারে বদলে গেছে। গ্রামের আদর্শ বলে যা বোঝায়, সে সবের অনেক কিছুই নেই। পরিবর্তনটা লক্ষ করছি ২০ বছর ধরে। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিবর্তনটা ঘটেছে অতিদ্রুত। গ্রামের ভারসাম্যহীন পরিবর্তনগুলো দেখে এবার মন বিষাদে ভরে গেল। আমি পরিবর্তনে বিশ্বাসী একজন মানুষ। পরিবর্তন আমার ভালো লাগে। কিন্তু সেই পরিবর্তনে কল্যাণের কমতি হলে মন তো বেদনায় নীল হবেই। আধুনিকতাকে ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে না আমি। কিন্তু জাম, জামরুল, কদবেল, আতা, কাঁঠাল, নারকেল, দেবদারুর পরিবর্তে ইউক্যালিপটাস কিংবা আকাশি গাছের বনায়ন তো মন ভরায় না।
কবেই হারিয়ে গেছে আমার সেই স্কুলে যাওয়ার মিষ্টি মেঠোপথ, ঝোপজঙ্গল, রাস্তার পাশের বিছুটি লতা, রাতদুপুরের চিরচেনা বাঁশির সুর, রাতবিরাতে দূর গ্রাম থেকে যাত্রাপালা দেখে বাড়ি ফিরতে থাকা কিশোরের গলা ছেড়ে গান। বন্ধুরা নেই। যারা শৈশবে সহপাঠী ছিল এককালে, তাদের কেউ এখন ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে চলে গেছে। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ মেলে না ১৫-২০ বছর। এই সময়ে কেউ বিয়ে করে সংসার পেতেছে। কেউ বা চাকরি-বাকরি নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। সংসার করা গ্রামের বন্ধুদের কয়েকজনকে দেখলাম, চেনাই যাচ্ছিল না তাদের। দাড়িমোচে একেকজন একাকার, প্রবীণ। অথচ এই সময়ে তাদের বয়স কতই বা হয়েছে আর?
বারবার মনে হচ্ছিল, আমার যদি বিল গেটসের মতো অনেক টাকা থাকত, আমি আবার গ্রামটিকে সেই শৈশবের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম। বন্ধুদের নিয়ে সংসার ফেলে পশ্চিমের বিলে পূর্ণিমা রাতে নৌকা ভাসাতাম। যে সুবিশাল গাছগুলো আমার শৈশবে যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল, যে বাড়িটি যেখানে অবস্থান করছিল, ঠিক সেটিকে সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম। মেঠোপথের দুই পাশে ঝোপঝাড়, বিছুটি লতা, সুপারির সারি- সব ফিরিয়ে আনতাম।
দেখলাম গ্রামের ধানক্ষেত, সরিষাক্ষেতগুলোও কমে গেছে। এখন আর কেউ আবাদেও তেমন উৎসাহী না। আবাদে খরচ বেশি। গ্রামে কোনো খেলার মাঠও ছিল না। ফলে আমরা জ্যৈষ্ঠে ধানকাটা শেষে সেই মাঠেই খেলাধুলা, ঘুড়ি ওড়ানোর পাল্লা দিতাম। এখন ঘুড়ি ওড়ানো সম্ভব না। মাঠের মাঝে নতুন গ্রাম হয়েছে। এখানে সেখানে বাড়ি উঠেছে। অপরিকল্পিত রাস্তা হয়েছে। সেই রাস্তার ধারে দেশীয় গাছের জায়গায় এসেছে আকাশচুম্বী সুদর্শনা ইউক্যালিপটাস, আকাশিসহ নানা বিদেশি গাছ। এ গাছ এ দেশের পরিবেশের সঙ্গে বড় বেমানান। এ গাছে কোনো পাখপাখালি বসে না। পাখিরা সেই দেশীয় বাঁশঝড়, কলাগাছ, আম-জাম, কাঁঠাল গাছেই বসে। অহেতুক কে যে ডেকে আনল ওই বিদেশি গাছদের। রাস্তাগুলোর দুই পাশে এদেরই রাজত্ব। এ যেন গ্রামের লাজুক বধূকে বিকিনি পরিয়ে দেওয়ার মতোন।
এখন গ্রামে লোকজন টাকা হলেই বাড়ি বানায়। রাস্তাগুলোর চারপাশে বাড়ির পর বাড়ি। ফাঁকা জায়গার বড় অভাব। গ্রামকে চেনা যায় না। আধাপাকা বাড়িগুলো মিলে এলাকার গ্রামগুলোকে দেখতে অনেকটা শহরের বস্তির মতোন করে ফেলেছে। ঠিক গ্রামের সঙ্গে যায় না যেন। প্রতিটি ঘরে ডিশ সংযোগও চলে এসেছে। সেখানে বাছাই করা চ্যানেল সেট করা। স্টার প্লাস থেকে সনি চ্যানেল। সবগুলোর বাংলা সংস্করণ। সবাই দেখছে। পাশের বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখলাম ফুল ভলিউমের সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে বলিউড নায়ক সালমান খানের নতুন সিনেমার গান ‘বেবি কো ব্যাস পছন্দ হ্যায়’। উৎসুক নারী-পুরুষ-শিশুরা সাপের খেলা দেখার মতো করে গোল হয়ে আছে। তারই মাঝখানে ১০ কি ১২ বছরের একটি শ্যামলা মেয়ে তিড়িং বিড়িং নেচে চলেছে। নাচে সেই গানের মুদ্রার নকল করার দৃষ্টিকটু চেষ্টা।
গানের আসরের পাশ দিয়ে আরো এগিয়ে গেলাম ঈদগাহ মাঠের পাশের উঁচুমতন এলাকাটিতে, যেটাকে আমরা আটার জমি বলতাম (আটা মানে কি আমি জানি না। তবে উঁচু জমিকে আমরা এটা বলতাম)। দেখি পুরো এলাকাটি নিচু করে ফেলা হয়েছে। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। আহারে! এই যে জমির চরিত্র, সে তাও হারিয়ে ফেলছে। এখানে উন্নতমানের মরিচের বিপুল চাষ হতো এই ১৫ বছর আগেও। এ গ্রামের মরিচের চাহিদা মিটিয়ে ৮০ ভাগই বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হতো। অথচ এখন কাঁচামরিচের কেজি ৩০০ টাকা।
বাহিরবাড়ি দাঁড়িয়ে সামনে তাকালাম। পালানের জমিগুলোর দিকে। বাড়ির সামনের জমিকে পালান বলতাম আমরা। এর সামনে আরেকটু এগিয়ে একটু নিচু এলাকার জমিকে বলতাম বাইদ। সেখানে বর্ষার শেষ দিকে শীতের ঠিক আগে আগে মাছ ধরার ধুম পড়ত। চাটা (ছোট খলসে), ছোট চিংড়ি, ডানকানা, গুচুই, শোল, পুঁটি, চান্দা, ছাইতান (টাকি মাছ), বেতরঙা, কৈ, বোয়াল, রুই, কাতলাসহ আরো কত রকমের মাছ। একেকটার স্বাদ একেক রকম। ছোট মাছগুলো সরষের তেলে চচ্চড়ি, কিংবা পুঁইশাকের সঙ্গে শুঁটকি! আহা কি সেই স্বাদ! মুখে লেগে আছে এখনো। এবার এগুলো কম পেলাম।
দূরে মরাত্রাই নদীর মোহনায় তালুকদারপাড়ার পেছনের একটি এলাকার নাম নইল্যাকুড়ি। আমি নিজে অনেক জানার চেষ্টা করেছি, এই নামের অর্থ বের করতে পারিনি। মুরব্বিদের কাছেও এর ব্যাখ্যা পাইনি। সেই ‘মাছের আড়ত’ নইল্যাকুড়িকে চিনতে পারলাম না। এর পাশের একটি জায়গার নাম জোঁকতলা। ৭০-৮০ বছর আগে নাকি এখানে জোঁকের প্রকোপ ছিল। জোঁক নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। কেউ সেখানে পাট কাটতে গেলে লবণ-সরিষার তেলের মিশ্রণ মেখে রীতিমতো যুদ্ধের আয়োজন করে পানিতে পাট কাটতে নামত।
আবাদি জমিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে একে একে। পরিচিত জমির আইলের মানচিত্র রেখা বদলে যাচ্ছে। আমার হৃদয়ের কোনে আঁকা সেই উঁচু-নিচু নানা নামের জমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে এলাম। আমার শৈশবের বিচরণ করা স্মৃতি হাতড়ে ফিরলাম, নাহ্। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই।
একবার মনে হলো জমিগুলোর ওপর কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে কাঁদি আর চিৎকার করে বলি, ‘আমার শৈশবের জমির মতোন জমিগুলোকে আবার সে রকম করে দাও, পথগুলো বাড়িঘরমুক্ত করে দাও, সেই বাইদ ফিরিয়ে দাও, সেই খাঁটি গ্রাম ফিরিয়ে দাও।’ এভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে পারলে হয়তো ভালো হতো। কিন্তু আমি হয়তো শহুরে ভদ্রলোক হয়ে গেছি। মাটিতে শুয়ে, সেই মাটি গায়ে মেখে কান্নাকাটি করা আমাকে আর মানায় না, মানাবেও না হয়তো।
ফেরার দুদিন আগে গোগ্রাসে মুড়মুড় করে ফুলপিঠা খাচ্ছিলাম। মা দেখে বললেন, ‘এই পিঠা তোদের এত পছন্দ, আগে বললে তো অনেকগুলো বানিয়ে রাখতাম, ঢাকায় নিয়ে যেতে পারতি।’ এ সময় খাবার টেবিলের পাশেই উপস্থিত ছিলেন প্রতিবেশী লালু ভাইয়ের স্ত্রী। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, তাঁদের বাড়িতে এক টিন বানানো আছে। সেগুলো তিনি দিয়ে দিতে চান এবং ঢাকায় আসার সময় সেগুলো তিনি দিয়েও দিলেন।
এই যে লালু ভাইয়ের স্ত্রীর মতো মানুষগুলোর হৃদয় এখনো সবুজই রয়ে গেছে। তারা প্রতিবেশীর প্রয়োজনে এখনো সবার আগে ছোটেন। সবার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন নিরন্তর। সবকিছু বদলালেও গ্রামের এই মানুষদের হৃদয়ের সবুজ রংটা যেন না বদলায়, সেই প্রার্থনাটা করে এলাম এবার।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।