সৈয়দ হক, নূরলদীনের ছায়া
এ দেশের মানুষ তাঁর হাত থেকে পেয়েছিল ‘নূরলদীনের সারা জীবন’। যে কোনো জাতি তার সংকটে বীরদের স্মরণ করে। সেই সঙ্গে নতুন কিছু রচনা করে। সেই জাতির সেরা শিল্পীরা তাতে ভূমিকা নেন। আর সৈয়দ শামসুল হক ইতিহাসের এই কর্তব্য সাধন করেছেন মাত্র।
বঙ্কিমচন্দ্র যেমন আনন্দমঠ রচনার বেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের যৌথ ইংরেজবিরোধী লড়াইকে শুধুমাত্র সন্ন্যাসীদের লড়াই হিসেবে হাজির করেছিলেন, সেখানে নূরলদীনের সারাজীবন-এ বাংলার কৃষক বিদ্রোহের সঠিক পাঠই হাজির করেছেন সৈয়দ হক।
এই ভূখণ্ডের মানুষ যে সেক্যুলার এক বাংলাদেশের জন্য জান বাজি রেখেছিলেন, সৈয়দ হক কৃষক সংগ্রামের এই বয়ান তুলে এনেছেন। তাঁর এই বয়ান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিপরীতে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বয়ান। ৫০-এর দশকে পূর্ব বাংলার সাহিত্যের ভাষাকে বাঙালদের সাহিত্যে পরিণত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জসিমউদদীনের পরই তিনি। কিন্তু আজ যখন আবারও স্বপ্ন লুট হয়ে যায়, যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়, তখন তাঁর কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু তিনি আর ডাক দেন না।
আজকের রামপালবিরোধী আন্দোলনে সুন্দরবন রক্ষার সংগ্রামে তাঁর নূরলদীনের ডাক শোনা যাচ্ছে। যদিও সৈয়দ হক নিজেই নিজ সৃষ্টির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। মৃত্যুযাত্রায় রচনারত শেষ যোদ্ধা তিনি হতে পারলেন না।
আহমদ ছফার নিহত নক্ষত্রের বদলে তিনি হয়ে গেছেন পতিত নক্ষত্র। আমরা এখন কার কাছে গিয়া জিগাব, ‘ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খেত রোয়? ক্যান মানুষজন এইভাবে পাল্টায়ে যায়?’
২
রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ গণকমিটির পক্ষ থেকে চিলমারী টু ঢাকা রুটে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের দাবিসহ ১১টি দাবির আন্দোলনের পাশাপাশি চলতি বছরের এপ্রিলের ১ তারিখে কুড়িগ্রাম পৌর হলে তাঁর সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কয়েকজন বক্তা তাঁর মৃত্যু নিয়ে কথা তুলেছিলেন। সেদিন তিনি কুড়িগ্রামে শায়িত হওয়ার কথা বলেছেন। সেদিন কুড়িগ্রামবাসী হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সেই কথামতো কুড়িগ্রামে তিনি আজ শায়িত হবেন।
তিনি কুড়িগ্রামবাসীর যথার্থই অভিভাবক ছিলেন। সংবর্ধনা সভায় কবি বলেছিলেন, গণকমিটির নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস নামে চিলমারী থেকে ঢাকা রুটে একটি আন্তনগর ট্রেন, চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ তিস্তা সেতুর নকশাঁয় রেলপথ যুক্ত করাসহ দাবিগুলো তুলে ধরবেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু এই গণদাবিকে কিছুটা বিলম্বিত করল বোধহয়।
আমরা জানি, পাণ্ডববর্জিত রাজবংশী ও কোচ রক্তের উত্তরাধিকার এই কুড়িগ্রামবাসী তাঁকে গর্বভরে বুকে ধরে রাখবেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁর ভক্তবৃন্দ ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস-যোগে হয়তো বা কুড়িগ্রামে সমাধিতে ফুল দিতে আসবেন।
এখন কুড়িগ্রামবাসী দাবি তুলেছেন, কবির নামে কুড়িগ্রামে একটা এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হোক, যেখানে পাঠাগারসহ কবির যাবতীয় ব্যবহার্য বস্তু থাকবে। যাতে কবির উছিলায় কুড়িগ্রাম তীর্থস্থান হয়ে ওঠে আগামীদিনের গবেষকদের জন্য। একদিন সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে যেভাবে মেশে, একদিন বাঙলা ভাষাভাষী সংস্কৃতিকর্মীরদের অন্যতম তীর্থে যেন পরিণত হয় তাঁর সমাধিস্থল।
৩
কুড়িগ্রাম কুড়িটি নদ-নদীর দেশ। তাই কুড়িগ্রামের সন্তান হিসেবে তাঁর তাবৎ রচনায় নদনদী একটি চরিত্র হিসেবে হাজির। শেখ রোকন সৈয়দ হকের ‘নদী কারো নয়’ উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন, আধকোশা যদি ধরলা হয়, তাহলে সৈয়দ শামসুল হকের কলমে উঠে এসেছে তাঁর শৈশবের প্রমত্তা নদী। যখন পুরাতন কুড়িগ্রাম শহর ক্রমেই ধরলার গর্ভে চলে যাচ্ছিল। বস্তুত ‘নদী কারো নয়’ উপন্যাসেও আমরা দেখি, আধকোশা নদীর ভাঙন থেকে জলেশ্বরী শহরকে রক্ষায় বড় লাটের কাছে পিটিশন দিতে গিয়েই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন মইনুল হোসেন মোক্তার। এ যেন গণকমিটির আন্দোলনের বর্ণনা।
আজ দেশব্যাপী যে নদনদীকে রক্ষার আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সৈয়দ হক যেন সেই আন্দোলনের তত্ত্বকার। কিন্তু এই আন্দোলনের মাঠে তিনি নেই, গ্যালারিতেও ছিলেন না। গুরু দ্রোণাচার্য যেন অস্ত্র ধরেছিলেন শিষ্যদের একলব্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি আমাদের তাঁর সৃষ্টির নিকটবর্তী করবে। ১ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সংবর্ধনার মানপত্রে বহমাত্রিকতায় রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর পরই তাঁর কথা বলা হয়েছিল, তাঁর মৃত্যুর পর তা আরো সত্য হয়ে উঠেছে। ইতিহাস তাঁর পাওনা ঠিকই বুঝিয়ে দেবে তাঁকে।
৪.
অধ্যাপক রাজ্জাক নাকি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ মানুষ হিসেবে বিদ্যাসাগর বা তাঁর মতো মানুষদের ধারে-কাছে আসতে পারবে না। বড় মানুষ আর বড় লেখক নাকি এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে নাকি বড় মানুষদের ছায়া থাকে। আজকের এই আকালের দিনে সৈয়দ হক মানুষ হিসেবে নূরলদীনের ছায়া হয়েই না ছিলেন, সেটাও তো কম না।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।