সৈয়দ হক আর লিখবেন না আমার বইয়ে মুখবন্ধ
২০০৪ সালের শেষ দিকে ঢাকায় চলে আসি। একমাত্র পুঁজি লেখালেখি। কুড়িগ্রামের জনপদে সাংবাদিকতা করেছি প্রায় সাত বছর। কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতায় আমার পদার্পণ। সে কারণেই সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে চিনেছি ভিন্নভাবে।
বিশেষ করে ২০০৪ সালে আমার লেখা প্রথম উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচন করি চিলমারীতে। চিলমারীতে আমার সাংবাদিকতার গুরু এস এম নুরুল আমিন সরকারের পরামর্শে ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রথম আলোর কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি সফি খান। তিনি তাঁর বক্তব্যে সৈয়দ শামসুল হককে বিস্তরভাবে তুলে ধরলেন। আমাকে শামসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় রাজার মতো যাঁর বিচরণ, সেই শামসুল হকের বাড়ি আমার নিজ জেলায়। ভাবতেই যেন বুকটা ভরে যায়। আমার লেখালেখিতে আরো আগ্রহ জাগিয়েছে।
সৈয়দ হকের পরাণের গহিন ভেতরে, নিজস্ব বিষয়, রজ্জুপথে চলেছি, বেজান শহরের জন্য কোরাস, অগ্নি ওজলের কবিতা বইগুলো সংগ্রহ করে পড়ে নিলাম। যতই পড়েছি, ততই কবির প্রেমে পড়েছি। প্রাঞ্জল শব্দের গাঁথুনি তাঁর। সফি ভাইয়ের কথা আর লেখালেখির তাড়না থেকে ছুটে আসি ঢাকায়।
ঢাকায় আসার পর প্রথমে দৈনিক যুগান্তরের ফিচার পাতায় কন্ট্রিবিউটিং শুরু করি। প্রায় প্রতিদিন যুগান্তরে যাই। একদিন দেখি সৈয়দ শামসুল হক যুগান্তরে এসেছেন। আমি ছুটে যাই তাঁর কাছে। বিনয়ের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিই। সৈয়দ শামসুল হক আমার সালাম গ্রহণ করলেন। কিন্তু কুড়িগ্রামের পরিচয় দেওয়ার পর তেমন কোনো আগ্রহ দেখালেন না। প্রথমেই আমার মনটা বিষিয়ে উঠল। ভাবলাম উনি তো অনেক বড় মাপের লেখক, তাই আমাকে পাত্তাই দিলেন না। পরে মনে পড়ল সফি খানের কথা। তিনি বলেছিলেন, শামসুল হক প্রথমে পাত্তা দেবেন না। তবে লেগে থাকতে হবে। যদি লেগে থাকতে পারো তাহলে সাহিত্যে অনেক সহযোগিতা পাবে। তাই মন থেকে কষ্ট মুছে ফেলে আবার তার কাছে গেলাম। শামসুল হক আমাকে দেখেই বললেন, কিছু বলবে? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’।
ঠিক আছে বলো। আমি বললাম, আমার বাড়ি কুড়িগ্রাম। আমি লেখালেখি করি।
তোমার বাড়ি কুড়িগ্রাম তো আগেই শুনেছি। বারবার বলতে হবে কেন?
তুমি লেখালেখি করো ভালো। লিখতে থাকো।
এই বলে চলে গেলেন শামসুল হক। মনটা আরো খারাপ হলো। ভাবলাম এত অহংকার ওনার!
কিছুদিন পর পাবলিক লাইব্রেরির এক অনুষ্ঠানে আবার দেখা হলো। অনেক কবি ভিড় ঢেলে সামনে গেলাম। শামসুল হকের হাতটা জোর করে ধরে বললাম, ভাই আমি ফারুক। বাড়ি কুড়িগ্রাম। ঢাকায় থাকি। লেখালেখি করি। পাশে থাকা একজন কবি বললেন, হক ভাইয়ের গ্রামের মানুষ। ওই অঞ্চলের মানুষরা সহজ সরল হয়।
হক সাহেব আমাকে বললেন, কী করো তুমি? আমি পুরো পরিচয় দিলাম। উনি হাসি দিয়ে বললেন, লেখালেখি করার নেশায় ঢাকায় এসেছো। এত সাহস তোমার। এই বিশাল মাঠে খেলতে পারবে তো?
আমি বললাম, আপনি সহযোগিতা করলে অবশ্যই পারব।
আবার হাসি দিয়ে বললেন, ‘শোন অধিকার কেউ দেয় না। অধিকার আদায় করে নিতে হয়। আমার জানা মতে, কুড়িগ্রামের মানুষদের সেই ধৈর্য সহ্য কম। দেখো কত দিন থাকতে পারো।’ এরপর কুড়িগ্রাম সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরলেন। চিলমারী বন্দরের সেই ইতিহাস আলোকপাত করলেন। তিনি বললেন, কুড়িগ্রাম জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপজেলা হচ্ছে চিলমারী। খুব মনে পড়ে গরুর গাড়িতে করে চিলমারী যাওয়ার কথা। কাঠের তৈরি গরুর গাড়ির ক্যাচর ক্যাচর শব্দ আর গাড়িয়ালের গান। এখন শুধুই স্মৃতি।
পাশে বসে অন্যজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কুড়িগ্রামের ধরলা নদী পাড়ি দিয়ে নাগেশ্বরী যাতায়াত করা লাগে। যখন ধরলার পানি শুকিয়ে যায়, তখন অনেক দূর বালুর পথ হেঁটে ঘাটে আসতে হত। জুতা, স্যান্ডেল হাতে নিয়ে সেই বালুপথ পাড়ি দিতাম। আর কত মজা হতো।’ এ কথা বলে সৈয়দ হক হাসলেন। তাঁর সঙ্গে উপস্থিত সবাই হাসলেন। সৈয়দ হকের মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা মনোবল পেলাম। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, সংক্ষিপ্ত সময়ে কুশলাদি বিনিময় হয়।
২০০৮ সালে একটি কবিতার বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিই। প্রায় ৬০টা কবিতা নির্বাচিত করি বইয়ের জন্য। এরপর ছুটে যাই সৈয়দ শামসুল হকের বাসায়। দেখা করে মনের বাসনা জানাই। আমার এই কবিতার বইটির মুখবন্ধ আপনি লিখে দেবেন। এ কথা শুনে কবিতাগুলো হাতে নিয়ে কিছু সময় ধরে উল্টে পাল্টে দেখলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, হক ভাই মুখবদ্ধ লিখে দিলে বইটা পাঠকমহলে সাড়া পাবে। আর আমি সাহিত্যের মাঠে একটু হলেও থাকতে পারব।
কিন্তু না। কিছুক্ষণ পর অনেকটা বিরক্তির স্বরে বললেন, ফারুক তোমার কবিতা হয়েছে। কিন্তু আমি এ ধরনের কবিতার বইয়ের জন্য মুখবন্ধ লিখব না। অন্য কাউকে দিয়ে লিখে নাও। পারলে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কাছে যেতে পারো। সে তোমার লেখাকে পছন্দ করলে মুখবন্ধ লিখে দিতে পারে। আর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে শাহরিয়ার অনেক ভালো লেখে। তার শব্দ ভাণ্ডার অনেক। আর কোনো যেহেতু তুমি আমার জেলার ভাই সেহেতু তোমার বইয়ের মুখবন্ধ আমি লিখে দেব অন্য কোনো বইয়ের জন্য। আরো ভালো করে কিছু কবিতা সাজাও। পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে ফিরে এলাম। যাওয়া হলো না আবু হাসান শাহরিয়ারের কাছে। কেননা, দৈনিক যুগান্তরে কাজ করার সুবাদে আবু হাসান শাহরিয়ার সম্পর্কে জেনেছি। তিনি আরো অনেক কঠিন মানুষ। সাহিত্যে চুল পরিমাণ ছাড় দেন না তিনি। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার দৈনিক আমাদের সময়-এর সম্পাদক হন। তিনি সম্পাদক থাকা সময়ে আমি সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। এ সময়ে দেখেছি আবু হাসান শাহরিয়ারকে নিয়ে সৈয়দ হক যা বলেছিলেন তার বাস্তবতা। পরে কবি ফরহাদ খাঁকে দিয়ে ওই বইয়ের মুখবন্ধ লিখে নিই। ফরহাদ খাঁ সস্ত্রীক খুন হয়েছেন তাঁর পল্টনের বাসায়।
কিন্তু মনের মধ্যে সব সময় কাজ করে তাড়া করে শামসুল হকের সেই কথা। তাই লিখে যাই কবিতা। কবিতাগুলো একত্র করে আমার পরিচিত কয়েকজন কবিকে দেখিয়েছি। তাঁরা সম্পাদনাও করে দিয়েছেন। কারণ এবার যেন সৈয়দ হকের কাছে গিয়ে ফিরে আসতে না হয়। মনে আশা ছিল আমার কবিতার দ্বিতীয় বইটির মুখবন্ধ সৈয়দ হকের কাছ থেকে লিখে নেব। তাহলে আমার সাহিত্য জীবনের পূর্ণতা পাবে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর খবরে তছনছ হয়ে যায় সে স্বপ্ন। মনের মধ্যে বারবার নাড়া দিচ্ছে, কথা রাখলেন না শামসুল হক। আর লিখে দেবেন না আমার কবিতার বইয়ে মুখবন্ধ।
আমার বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরে। কবি শুয়ে থাকবেন কুড়িগ্রাম-উলিপুর সডকের পাশে সরকারি কলেজের মাঠে। বাড়ি যাওয়ার পথে তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারব। তখন কবিকে বলব, কেন লিখে দিলেন না আমার বইয়ের মুখবন্ধ।
লেখক : সাংবাদিক, লেখক