পাক-ভারত সংকট
ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের দামামা!
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত পাকিস্তান বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। দুই দেশের সীমান্তে চলছে সমরসজ্জা। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে দুই দেশেই তাদের দীর্ঘ সীমান্ত থেকে বেসামরিক লোকজন অপসারণ করছে।এতে দুই দেশের সাধারণ মানুষের জন্য নেমে এসেছে অনেক দুর্দশা। সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক আর উত্তেজনা। দুই দেশের যুদ্ধবাজ নেতারা এবং যুদ্ধাংদেহী সেনাপতিরা যুদ্ধের আগে বাকযুদ্ধের মহড়া দিচ্ছেন। সাজ সাজ রব সর্বত্র। তাহলে কি শান্তির বাণী সাধারণ মানুষের আকুতি নীরবে নিভৃতে কেঁদে মরবে? সত্যিই কি যুদ্ধের দামামা বাজবে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে?
‘সম্মূখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি’। ঘটনার পর ঘটছে ঘটনা। ক্রিয়ার বিপরীতে দেখা দিচ্ছে প্রতিক্রিয়া। অশান্ত কাশ্মীরে অব্যাহত নিপীড়ন নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনা ছাউনি উরিতে হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানে ১৯ ভারতীয় সেনা সদস্য নিহত হন। এর আগে পাঠানকোটে একই ধরনের হামলা চালানো হয়। উপর্যুপরি হামলায় ভারত বিব্রত হয়।বিশেষ করে উরিতে বিপুল ভারতীয় সেনা নিহত হলে নরেন্দ্র মোদি সরকারের কাছে এটি ইজ্জতের সওয়াল হয়ে দাঁড়ায়। ভারত যথারীতি এ জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। পাকিস্তান ঘটনার দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করে। তারা তাদের গতানুগতিক বিবৃতিতে ঘটনাকে কাশ্মীরি জনগণের ক্ষোভের প্রকাশ বলে দায় এড়াতে চায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হামলকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ভারত পাকিস্তানকে ঘরে বাইরে কোনঠাসা করার প্রয়াস চালায়। পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্ররূপে প্রমাণ করার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে ভারত। সাথে সাথে সামরিক প্রস্তুতি চলতে থাকে।
যেহেতু বর্তমান ভারত একটি হিন্দু মৌলবাদী সরকার দ্বারা পরিচালিত সেহেতু প্রতিত্তুরের তীব্রতাও সেরূপ হওয়া স্বাভাবিক। ভারতের সামরিক কৌশলবিদরা উরি হামলার উৎকৃষ্ট জবাব দেওয়ার জন্য অনুশীলন করতে থাকেন। দুটি পারমাণুবিক শক্তির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ যে কেবল ধ্বংসই ডেকে আনবে ভারতের সমরবিদরা তা অনুধাবনে সক্ষম। সুতারাং তারা ভারতের ইজ্জত রক্ষা এবং ক্ষুব্ধ জনমতকে একটি মনস্তাত্তিক জবাব দেওয়ার জন্য কৌশল গ্রহণ করেন। এ কৌশলের অর্থ হচ্ছে,‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।’ পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ভারত জয় লাভ করবে ।ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংখ্যাধিক্য,সমরসজ্জা এবং পারিপার্শ্বিকতা তাদের পক্ষে। কিন্তু ‘বার হাত নিতে হলে,তের হাত যেতে হয়’। এই ফর্মূলায় ভারতের সমরবিদরা সম্ভবত সংযমের পরিচয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে ভারতের গৌরব এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার জানান দিতে তারা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বা ‘ঝটিকা সেনা অভিযানে’র সিদ্ধান্ত নেয়।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা ঝটিকা সেনা অভিযান হচ্ছে একটি সমর কৌশল। এই সামরিক অভিযানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শত্রুপক্ষকে অতিদ্রুততার সাথে আঘাত করে নিরাপদে ফিরে আসা। এটা করা হয় রীতিমতো আলোর গতিতে এবং এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম হিসাব করা হয়। অভিযানটি সার্বিক সাফল্যের নিশ্চয়তায় সম্পন্ন করা হয়। ইসরাইল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে এ কৌশল অবলম্বন করে আলোর গতিতে মিসরীয় বিমান বাহিনীকে ভূমিতেই ধ্বংস করে দেয়। ভারত ইসরায়েলের প্রশিক্ষণে কৌশলটি রপ্ত করে। এ কৌশলের মাধ্যমে গত জুন মাসে ভারত মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ৭০ জন কমান্ডো প্রেরণ করে ৪০ মিনিটে ৩৮ জন নাগা বিদ্রোহীকে হত্যা করে। এবার তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ কৌশল প্রয়োগ করে।
ভারত গত বুধবার রাতে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর অভ্যন্তরের তিন কিলোমিটার ভিতরে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে এই হামলা চালানো হয় বলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। ভারতের সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন(ডিজিএমও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল রনবীর সিং তাঁর প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন,‘কয়েকটি জঙ্গিগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে ঢুকে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সুনির্দিষ্ট ও যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতেই এ হামলা করা হয়। রনবীর সিং আরো বলেন যে, তিনি পাকিস্তানের ডিজএমওকে এ হামলার বিষয়টি জানিয়েছেন। তবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এ হামলার দাবি সম্পূর্ণ নাকচ করেছে। নিরাপত্তা সূত্রের বরাদ দিয়ে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা ঝটিকা সেনা অভিযানেরর মতো ঘটনা ঘটেনি। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ঘটনাটিকে সীমান্তে তুমুল গোলাগুলি বলে চিত্রিত করতে চায়। তারা আরো দাবি করে যে, ওই গোলাগুলিতে তাদের দুজন সৈন্য নিহত হলেও পরবর্তী সীমান্ত সংঘর্ষে কমপক্ষে আটজন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন।পাকিস্তান আরো দাবি করে যে, পাকিস্তান বাহিনীর গুলির ভয়ে ভারতীয়রা মৃতদেহ উদ্ধারেও উদ্যোগ নেয়নি। পাকিস্তান সংবাদ মাধ্যমের খররে দাবি করা হয় যে, এক ভারতীয় সেনাকে আটক করেছে। তবে এ দাবি নাকচ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেনা সূত্রের বরাত দিয়ে পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়,পাকিস্তান ভারতীয় সেনা নিহত ও আটকের যে খবর দিচ্ছে তা মিথ্যা ভিত্তিহীন। কিন্তু ভারতের নিরপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানায় ৩৭ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের এক সদস্যকে যে পাকিস্তানি পক্ষ অস্ত্রসহ আটক করেছে তা নিশ্চিত। বার্তা সংস্থা জানাচ্ছে যে, দুই পক্ষে দাবির সত্যতা কোনো নিরপেক্ষ সূত্র দ্বারা যাচাই করা যায়নি। তবে অপ্রিয় সত্য এই যে, হামলা প্রতিহামলার ঘটনা পরমাণু শক্তিধর দুই বৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে নতুন করে সংঘাতের আশংকা সৃষ্টি করেছে।
দুই রাষ্ট্রের মধ্যেই সাজ সাজ রব পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে নিরাপত্তা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক আয়োজন করেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় অস্ত্র বিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা প্রমাণ করে যে, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করছে। অপরদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ভারতীয় হামলার পর পরই মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন। পাকিস্তান সেনাবহিনীর সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভারত বাজার গরম করার চেষ্টা করছে।তাদের তরফ থেকে আরো বলা হয় যে,পাকিস্তানের মাটিতে ভারত যদি কোনো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায় তাহলে পাকিস্তানও একই উপায়ে জবাব দেবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ভারতীয় হামলার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন।পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাওয়াজ আসিফ হুমকি দিয়েছেন, ‘শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য পরমাণা বোমা বানায়নি পাকিস্তান।আমাদের ওপর হামলা করার সাহস দেখালে ভারতকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে।’ পাকিস্তান বিমান বাহিনীকে আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে বাহিনী প্রধান নিশ্চিত করেছেন। যুদ্ধের আশংকায় পাকিস্তান উপকূল ঘেষে নৌবাহিনী মোতায়েন করছে ভারত। ভারতের একটি মিডিয়ায় জানানো হয় গুজরাট উপকূ’লে রয়েছে ৩৬টি যুদ্ধজাহাজের বিশাল বহর। বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো উভয় রাষ্ট্রের আকাশ সীমায় মহড়া দিচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হলো উভয় রাষ্ট্রের ১০ কিলোমিটার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সাধারণ মানুষকে অপসারণ করা হচ্ছে। ভারত তার পাঞ্জাব সীমান্তে আক্রমণের আশংকায় সব নাগরিককে সরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তান যদি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে যুদ্ধের সম্ভাবনা তীব্রতর হবে। কোনো পক্ষই যদি সংযম না দেখায় তাহলে তা হবে উভয় দেশের জনগণের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়।
ভারত পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা গোটা বিশ্বে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়কে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।চীন দৃশ্যত পাকিস্তানের পক্ষেই রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করবে। ভারতের পুরোনো মিত্র রাশিয়া ক্রমবর্ধমান ভারত-মার্কিন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাথে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে ভারত মার্কিন সামরিক মহড়া ও সামরিক সহযোগিতা বিশেষভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। চীনের অপ্রতিরোধ্য অগ্রাসনে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সমরবিদরা ভারতকে আরো জোরদারভাবে মার্কিন বলয়ে দেখা যাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করছেন। সুতরাং যুদ্ধ সংঘটিত হলে বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমীকরণে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।