পাক-ভারত সংকট
সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত খণ্ডযুদ্ধ
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন প্রায় প্রতি রাত্রেই আমরা গোলাগুলির শব্দ পেতাম। ব্যাপারটা কোনো একপর্যায়ে এমন হয়ে গেল যে, কোনো একদিন গোলাগুলির শব্দ না শুনলে আমরা সকালে উঠে বলাবলি শুরু করতাম, অর্থাৎ যেদিন গোলাগুলি না শুনতাম সে দিন আমাদের কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকত।
১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৯ বৎসর পাকিস্তান ও ভারত সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত আছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে প্রচলিত যুদ্ধ হয়েছে মোট চারটি । সেই সাথে অসংখ্য সীমান্ত খণ্ডযুদ্ধ ও সামরিক অচলাবস্থা। প্রিয় পাঠক হয়তো শুনে অবাক হবেন, এই চারটি যুদ্ধের মধ্যে তিনটিই হয়েছে কাশ্মীর নিয়ে। আর একটি হয়েছে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। আর হালের ভারতের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” হলো সর্বশেষ সীমান্ত খণ্ডযুদ্ধ। সুতরাং কাশ্মীর সীমান্তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা এখন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। লক্ষ করবেন এসব যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় কেউই পরাজয় স্বীকার করে না। আর এ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে লাখ লাখ নিরীহ নাগরিক। এ যুদ্ধেই দুই দেশের খরচও হচ্ছে অনেক। বলা হয়ে থাকে কাশ্মীর সীমান্তে সৈন্যদের নিকট রসদ সরবরাহের খরচ এতবেশি যে, একটি রুটির দাম পড়ে প্রায় ৭ ডলার।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টায় ভারতীয় ছত্রীসেনারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক শুরু করেন। এটা কোনো অপারেশনের নাম নয়। এটা হলো একটি অপারেশন পদ্ধতি যাতে কো-ল্যাটারেল ড্যামেজ না করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়। এটা নূতন কিছু নয়। এর আগেও ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান আক্রমণের সময় নির্দিষ্ট লক্ষ্যগুলোতে আঘাত হেনেছিল। হালের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে লাইন-অব কন্ট্রোল বরাবর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছত্রিসেনারা অবতরণ করে তা অতিক্রম করে। তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ৩ কিলোমিটার ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত কাশ্মীরের ভিম্বার, হটপ্রিং, কেল ও লিপা সেক্টরে ভারতীয় কমান্ডোরা আক্রমণ চালায়। সন্ত্রাসীদের আস্তানাগুলোর অবস্থান ছিল সীমান্তের ৫০০ মিটার থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে। সর্বমোট সন্ত্রাসী আস্তানা ছিল সাতটি। এই সন্ত্রাসী আস্তানাগুলোতে আক্রমণ করে ভারতীয় কমান্ডোরা ৩৮ জন সন্ত্রাসী ও ২ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যার দাবি করে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাদের গাইড এবং তাদের প্রশ্রয়দাতারাও ছিল বলে ভারতীয়রা দাবি করছে। অপারেশন চলে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। ছত্রীসেনারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছিল বলে জানা যায়। এটা নিঃসন্দেহে গত ৮ সেপ্টেম্বর উরি আক্রমণের প্রতিশোধ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক শেষ হওয়ার পর পরই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চিরাচরিত বাদানুবাদ ও গাল-গপ্প শুরু হয়েছে। পাকিস্তান বলছে তারা ৮ ভারতীয় সেনা হত্যা ও এক ভারতীয় সৈন্যকে আটক করেছে। ভারত দাবি করছে তাদের কোনো সেনা হতাহত হয়নি। যে সেনা আটক হয়েছেন তিনি আদতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে অংশগ্রহণ করেননি। দায়িত্বরত অবস্থায় অসাবধানতা বশত নিয়ন্ত্রণ রেখা পার হয়ে গিয়েছিলেন মাত্র।
যা হওয়ার তাই হলো। এ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর ভারতীয় বিএসএফ সীমান্তে হাই-এলার্ট জারি করেছে। জওয়ানদের ছুটি বাতিল করেছে এবং সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী সব বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার মানে যুদ্ধ শুরু হলো, এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে।
সত্যি বলতে কি, ভারত ও পাকিস্তানের এ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা গোটা পৃথিবীকে অশান্তিতে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধের প্রধাণ কারণ কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ। দুটি রাষ্ট্রই কাশ্মীরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কিন্তু কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে তারা কেউ নেই।
ভারতের এই সর্বশেষ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পরিস্থিতি কোন দিকে নিয়ে যায় তাই দেখার বিষয়। এরই মদ্যে ভারত একটি যুদ্ধ-স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করা শুরু করেছে। এটা হলো প্রো-একটিভ অথবা প্রি-এমটিভ আঘাত হানার স্ট্র্যাটেজি। পাকিস্তান যদি একটি গুলি করে তাহলে ভারত করবে দুটি। ভারতীয় কমান্ডোদের বার্মা সীমান্তে কিছুদিন আগে সন্ত্রাসী ক্যাম্পে আক্রমণ তারই একটি অংশ। ইতিমধ্যে ভারত পাকিস্তানকে বিশ্ব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে ইরান পাকিস্তানের সীমান্তে আক্রমণ পরিচালনা করেছে। এসব থেকে বোঝা যায়, ভারত আপাতত সীমান্ত-খণ্ডযুদ্ধ ও বিশ্বসমাজ থেকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে, কিন্তু কোনো প্রচলিত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ যুদ্ধ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক নাজুক করে ফেলবে। পাকিস্তান হয়তো এটাই চায়। পাকিস্তানের হারাবার খুব বেশি কিছু নেই। কারণ পাকিস্তান ইতিমধ্যেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে আত্ম প্রকাশ করেছে। তাদের এখন বাকি আছে সীমান্তে যুদ্ধ বাধিয়ে সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ওপর জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ।
লেখক : মেজর, পিএসসিজি (অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিসনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত।