আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস
সহিংসতা বিবর্জিত বিশ্ব চাই
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন একটি দিবস পালনের খুবই প্রয়োজন। চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে সহিংসতা। পরিবেশের যেমন কোনো বাউন্ডারি নেই, তেমনি বাউন্ডারি নেই সহিংসতার। সহিংসতার বিপরীতে অবস্থান হলো অহিংসতা বা শান্তির। সেই শান্তির প্রত্যাশায় পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস, ইংরেজিতে তা হলো, ‘ইন্টারন্যাশনাল নন-ভায়োলেন্স ডে’।
এটি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ভারতের জাতীয় নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ২ অক্টোবর বিধায়, সেই জন্মদিন পালনের দিনে দিবসটি পালন করা হয়। কারণ বিশ্ব ইতিহাসে একজন অহিংস সংগ্রামী হিসেবে পরিচিত মহাত্মা গান্ধী। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আন্দোলন সংগ্রামসহ প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামই অহিংস হিসেবে করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সবসময় সহিংসতাই একমাত্র সমাধান নয়, বরং অহিংস আন্দোলনেও সফলতা অর্জন সম্ভব। সেই প্রেক্ষাপটেই, আর এ দিবস পালনের জন্য একজন ইরানি নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদি সর্বপ্রথম জাতিসংঘে ২০০৪ সালের প্রস্তাব করেন যে, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সহিংস বিশ্বে অহিংস আন্দোলনের সফল নেতা মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনটিকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে পালন করা যায়। সেজন্য জাতিসংঘ তা গ্রহণ করে এবং ২০০৭ সালের সাধারণ পরিষদের সভায় অনুমোদিত হলে তখন থেকেই ২ অক্টোবরকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
আমি শুরুতেই বলেছিলাম, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে এখন যেভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দানা বেধে উঠেছে সেখানে আজকের এ দিবস পালন সত্যিকার অর্থেই অনেক গুরুত্ব বহন করে। বর্তমান সহিসতায় যেমন বাদ যাচ্ছে না খ্রিস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, হিন্দু অধ্যুষিত দেশগুলো তেমনি বাদ যাচ্ছে না মুসলিম দেশগুলোও। শুধু তাই নয় ঈদের নামাজ, শুক্রবারের জুমার নামাজসহ মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় পর্যন্ত জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ মারছে। অথচ এরা এসব কাণ্ড-কারখানা করছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত জেএমবি, হিজবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল কায়েদা, আইএস ইত্যাদি কিছু জঙ্গিবাদী সংগঠন যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারের নামে। কিন্তু ইসলাম হলো সর্বজনবিদিত একটি শান্তির ধর্ম।
তা ছাড়া জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি, সিরিয়ায় আইএস নিধনের নামে চলছে শক্তিধর দেশগুলোর আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ দিয়ে শক্তির মহড়া। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন তো শতাব্দীর সমস্যায় রূপ নিচ্ছে এখন। অপরদিকে সৌদি আরব, ইরান, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো রয়েছে নানা সমস্যায়। বাদ নেই শান্তিপুরীখ্যাত ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোও। এসব স্থানে কখনো কখনো ফুলে-ফেপে উঠছে, যুদ্ধ যুদ্ধভাব তৈরি হচ্ছে যা বিশ্ব শান্তির অন্তরায়। কিন্তু শ্রীলংকায় তামিল বিদ্রোহ দমনের এলটিটিইকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হাজারো মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে দীর্ঘদিনের সহিংসতায়। কিন্তু সেই বিদ্রোহ দমনের জন্য শ্রীলংকার সরকারকে সহিংস অবস্থানে রীতিমতো বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু নিকট অতীতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাদের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দেশের জনগণের সহায়তায় ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছেন অহিংসভাবে।
ঠিক সেই রকমভাবে আমাদের বাংলাদেশের এক সময়ের অশান্ত পার্বত্য এলাকায় যখন শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহ চলছিল, বিভিন্ন সময়ে যখন সহিংসতায় অনেক লোক মারা যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দেশের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের আমলে অহিংসভাবে সমস্যা সমাধানের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য এলাকার শান্তিবাহিনীখ্যাত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে এক শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হন তাঁরা। সেখানে এখন টুকিটাকি সামান্য সমস্যা মাঝেমধ্যে দেখা দিলেও মোটাদাগে বিষয়টির একটি অহিংস নিষ্পত্তি যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও এখনি শেষ কথা বলার সময় আসেনি, তারপরও একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, সাম্প্রতিক কিছু জঙ্গি-সন্ত্রাসী সহিংস ঘটনায় বিশ্ব নেতৃত্ব যেভাবে একসাথে কাজ করতে শুরু করেছে তার একটি দৃশ্যমান সফলতা এরই মাঝে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আর অল্প কিছুদিন যাবৎ সেগুলোর বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থা কাজে আসছে।
আজকের আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস পালনের এদিনে সবাইকেই একটি বিষয়ে শপথ নেওয়া প্রয়োজন যে সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিলে মানুষে মানুষে হিংসা হানাহানি দিন দিন বেড়েই চলে, এতে শুধু সম্পদ ও জানমালের ক্ষতিই হয়। কিন্তু কারো কোনো লাভ হয় না। কাজেই প্রত্যেকটি বিষয়কে রাজনীতিকীকরণ না করে বিশ্ব শান্তির স্বার্থে তা পরিহার করা উচিত। কারণ রাজনীতি তো মানব কল্যাণের জন্যই। আসুন আজকের দিনে আমরা সবাই সহিংসতা পরিহার করে অহিংস বিশ্ব গঠনে কাজ করি।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়