বিশ্ব বসতি দিবস
সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিত হোক
ইংরেজিতে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাবিটেট ডে’, যার বাংলা প্রতিশব্দগত তরজমায় একে বিশ্ব বসতি দিবস বলা যেতে পারে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বে সব মানুষের আশ্রয়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রেজুলেশন পাস করানো হয়। তার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৮৬ সাল থেকে প্রতিবছরের অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার দিবসটি পালনের জন্য ঠিক করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট এ দিনটিতে একটি প্রতিপাদ্য থিম হিসেবে ধরে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়ে আসছে।
১৯৮৬ সালে প্রথম বছর এর প্রতিপাদ্য ছিল ‘শেলটার ফর অল’। সেভাবেই ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে থিম ঠিক করে বিশ্ব বসতি দিবস পালন করা হচ্ছে। এবারও ২০১৬ সালের অক্টোবরের প্রথম সোমবার, অর্থাৎ ৩ অক্টোবর এ দিবস জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় পালন করা হচ্ছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি হলো নাগরিক মৌলিক অধিকার। তার মধ্যে কোনোটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি চলতে পারে না। একটি শিশু জন্মানোর পরপরই তার মুখে যেমন খাবার তুলে দিতে হয়, তেমনি খাবার খাওয়ার পর তাকে দিতে হয় বস্ত্র। খাদ্য ও বস্ত্র নিশ্চিত হলে তার পরেই প্রয়োজন হয় আশ্রয়ের। আর সেই আশ্রয়ের জন্যই বর্তমান ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাপে তা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিশ্বে বর্তমানে জনসংখ্যা হলো প্রায় ৭০০ কোটি। এ বর্ধিত জনসংখ্যার আশ্রয়ের জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ বসতবাটি। কিন্তু সেই পরিমাণ বসতবাটি কি সবার পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব? এমনিতেই এ খাতে হচ্ছে একটি অসম প্রতিযোগিতা। একদিকে উঠছে অসংখ্য আধুনিক ইমারতশৈলী, অন্যদিকে রাস্তার ধারে বেড়ে চলেছে বস্তিবাসীর সংখ্যা। এ ব্যবধান দিন দিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, বিশ্বে এখন প্রায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষের আশ্রয় সমস্যাযুক্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে বিশ্বের প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষের কোনো থাকার জায়গা নেই। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব বসতি দিবস পালন করা সত্যিই যথোপযুক্ত হয়েছে।
বসতি স্থাপনের জন্য গ্রাম, শহর, উপশহর ইত্যাদি অনেক স্থানকে বেছে নেওয়া হয়। সেখানে আবার পরিবেশ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কারণ, মানুষের বাসস্থানের সঙ্গে পরিবেশ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো স্থানে মানুষের বসবাসের জন্য যেমন পরিবেশসম্মত স্থান প্রয়োজন, অন্যদিকে সেই স্থানে আবার মানুষ কর্তৃক পরিবেশ বিনষ্টকারী কিছু উপাদানও তৈরি হয়। যা হোক, মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, সর্বদাই তার বাসস্থানের জন্য একটি নিরাপদ স্থান খুঁজে ফেরে। যেমন পাহাড়ের ওপরে, পাতালে, নদী, সাগর, মহাসাগর যার ধারেই হোক না কেন, সেটা যেন তার জন্য নিরাপদ হয়। মৃত্যুঝুঁকি যেন কম থাকে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা-খরা, বৃষ্টি-বাদল, শীত-গরম, বরফ-কুয়াশা ইত্যাদি অনেক কিছু থেকেই মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। ইদানীংকালে আবার ভূমিকম্প-সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কথায় কথায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে মানুষ।
বাংলাদেশে এক ঢাকা শহরে ছিন্নমূল মানুষের দিকে তাকালেই গৃহহারা মানুষের করুণ দৃশ্য চোখে যেন দেখে সহ্য করা যায় না। রাস্তার ধারে, রেললাইনের ধারে, বড় বড় ইমারতের পাশে, খোলা আকাশের নিচে, গাছের নিচে, এমনকি কখনো কখনো গাছের ডালে (রাজধানী ঢাকার খোদ সচিবালয়ের কাছে আবদুল গনি রোডের ধারে হাইকোর্টের পাশের বেশ কয়েকটি গাছের ডালে কয়েকটি বস্তিঘর গাছে বাবুই পাখির বাসার মতো ঝুলতে লক্ষ করা যায়), রাজপথের আন্ডারপাস, ওভারপাস, ফ্লাইওভার, ব্রিজ, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, পার্ক, হাটবাজার, মাঠ-ঘাট, শপিংমল, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে, সোনারগাঁও, পূর্বাণী, সুন্দরবন ইত্যাদি পাঁচতারকা মানের হোটেলের পাশেও এসব বস্তি দেখা যায়। বস্তিবাসীর তো আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই-ই, কিন্তু এখন সরকারের তরফ থেকে নদীর চর, খাস জমি, রাজধানীর পতিত সরকারি জায়গা ইত্যাদিতে আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি শ্রেণিভিত্তিক আবাসন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কোথাও কোথাও এরই মধ্যে করেও দিয়েছেন। কিন্তু চাইলেই তো আর সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা সরকার একেবারে হয়তো করতে পারবে না।
সে জন্য দল-মত-পথ সব বিবেচনায় বিত্তবানদের দারিদ্র্য বিমোচনের কাতারে শরিক হয়ে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু বিত্তবানদের বসতবাড়িকে নিরাপদ করতে হলেও কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। কারণ, এখন অনেক পুরাতন বাড়ি দীর্ঘকালের আবর্তনে ভেঙে পড়তে পারে। সঠিক বিল্ডিং কোড, যেমন—সঠিক ও মানসম্পন্ন বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল, অর্থাৎ ইট, বালি, পাথর, সিমেন্ট, রডসহ অন্যান্য বিষয় সঠিক মানে ও পরিমাণে ব্যবহার করা। ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্প সহনীয়ভাবে সঠিক প্রকৌশল প্রযুক্তিজ্ঞান ব্যবহার করা। কোনো একটি স্থানে একটি বাড়ি বানাতে হলে সেখানকার অনেক কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। সেখানে পরিবেশগত বিষয়টি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেখা গেছে, কোনো স্থানের বাড়িঘরের সঙ্গে খোলা জায়গা কিংবা পরিবেশবান্ধব গাছগাছালি কত শতাংশ জায়গাজুড়ে থাকবে, তা মিলিয়ে নিতে হবে।
কাজেই আজকের এ দিবস পালন করতে গিয়ে একটি বিষয়ে শপথ নিতে হবে যে বিশ্বের সব শ্রেণির মানুষের জন্য নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য গরিবদের পাশে ধনীদের এসে দাঁড়াতে হবে। তাহলেই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।