বিশ্ব শিক্ষক দিবস
শিক্ষকদের মর্যাদাই সবার ওপরে
শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষকের একটি বিরাট সম্পর্ক রয়েছে। আর সে শিক্ষার কোনো বয়স কিংবা শ্রেণি-পেশা ইত্যাদি কোনো ভেদাভেদ নেই। শিক্ষা যে শুধু প্রাতিষ্ঠানিকই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। অন্যদিকে শিক্ষক বলতে যে শুধু প্রথাগত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হবে এমনও কোনো কথা নেই। যিনি জীবনের কোনো একটা কিছু কাউকে শেখান, তিনিই আসলে শিক্ষক।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় আইসিটি বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার সেই অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘জয় আমার শিক্ষক।’ কারণ, তিনি তাঁর ছেলে হলেও বিশিষ্ট কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জয়ের কাছ থেকে এ বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছেন এবং তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ও ডিজিটাল দেশের দিকে নিয়ে যেতে সমর্থ হচ্ছেন। কাজেই এখানে শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজের সন্তানকেও শিক্ষক মানতে কারো কোনো অসুবিধা নেই। এটিতে প্রকারান্তরে শিক্ষকদের মর্যাদাই তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন এবং শিক্ষকদের তিনি সে সম্মান দিয়েছেন।
শিক্ষকের মর্যাদা-সংক্রান্ত বিষয়ে মোগল বাদশা আলমগীরের ঔদার্য নিয়ে লিখিত কবির কবিতার কয়েকটি চরণ এ রকম, ‘বাদশা আলমগীর, কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর..., আজ থেকে চির উন্নত হলো শিক্ষা গুরুর শির, সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর।’ কাজেই যুগে যুগে যে শিক্ষকের মর্যাদা ছিল, এটা তার একটি বড় প্রমাণ। আমার দুই সন্তান ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ছে। দুই ক্লাসে তাদের দুজন ক্লাস টিচার রয়েছে। আবার তারা যে কোচিং সেন্টারে কোচিং করছে, সেখানেও তাদের শ্রেণিশিক্ষক রয়েছে। অভিভাবক হিসেবে প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে আমার আলাপ করতে হয়। সেখানে মোবাইল কিংবা টেলিফোন অথবা সরাসরিও অনেক সময় আলাপের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আগেপিছে না ভেবে আমি সর্বদাই তাঁদের স্যার বলেই সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করে থাকি।
এখানে অনেকে হয়তো আমার সঙ্গে একমত হতেও পারেন, আবার নাও হতে পারেন। কারণ, শিক্ষক মানে শিক্ষকই। অনেকে হয়তো বলে থাকবেন, তাঁরা আমার থেকে নিচের পদমর্যাদার চাকরি করেন। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সে রকম ছোট-বড় মর্যাদার নয়। বিষয়টি হলো শিক্ষক হিসেবে সম্মানের ও মর্যাদার। কারণ প্রত্যেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত (যিনি যতটুকু পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন) পুরো শিক্ষাজীবনে অনেক শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেছেন। তাঁরা লেখাপড়া শেষ করে অনেকে অনেক বড় পদে চাকরি করছেন এবং করে থাকেন। এমনকি এ দেশের সচিব, এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি প্রমুখ সকলেই ছাত্রজীবনে কারো না কারো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু তাঁরাও তাঁদের শিক্ষক গুরুদের নিকট যথাযথ সম্মানের সঙ্গে আচার-ব্যবহার করে থাকেন। এখানেই হলো শিক্ষকদের মর্যাদা।
অনেক শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, যাঁরা মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও বেশি টাকা আয়ের চাকরির পেছনে না ছুটে ছা-পোষা টাইপের শিক্ষকতাকে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে ব্রত হিসেবে নিয়ে নামেমাত্র অর্থে স্বেচ্ছায় শিক্ষকতার পেশায় এসেছেন। আবার টাকার জন্য প্রাইভেট টিউশনি কিংবা অনৈতিকভাবে কোচিং বাণিজ্যেও সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, এমন শিক্ষকও সমাজে রয়েছে। কেউ কেউ আবার শিক্ষার জন্য আত্মঘাতী হিসেবে পরিচিত প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভর্তি বাণিজ্যের মতো ঘৃণ্য কাজের সঙ্গেও জড়িয়ে কলঙ্কিত পুরো শিক্ষকসমাজকে। শিক্ষকতা কোনো চাকরি নয়, এটি একটি সেবা। জনকল্যাণে নিজেকে সবার মাঝে উৎসর্গ করার মতো উদারতা নিয়েই অনেকে শিক্ষকতার পেশাতে আসক্ত হতে দেখা গেছে। আর এ রকম একটি মর্যাদাশীল সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে পরিচিত ইউনেস্কো ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছরের ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। সেই বছর থেকেই জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় শিক্ষকদের মর্যাদাশীল এ দিবস পালন করা হয়ে আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের নানা সংগঠন দিবসটি পালনের জন্য তাদের মতো করে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। শিক্ষকদের অনেক অপ্রাপ্তি রয়েছে, রয়েছে তাঁদের অনেক দাবি-দাওয়াও। কাজেই এ দিনটিকে সামনে নিয়ে তাঁরা তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলো পেশ করে থাকেন। তার মধ্যে হয়তো কোনোটি পালন হয়, আবার হয়তো কোনোটি পালন হয়ও না।
যা হোক, শিক্ষকরা সমাজকে দেন বেশি, কিন্তু নেন খুবই কম। তাই তাঁদের চাওয়া-পাওয়াও কম। সে জন্য জাতিসংঘ যে তাঁদের মর্যাদার স্বীকৃতিস্বরূপ এ দিবস আন্তর্জাতিকভাবে পালন করে থাকে, সে জন্য তাঁরা খুবই কৃতজ্ঞ। শিক্ষকতা করতে করতে তাঁরা অনেক সময় নিজের দিকে খেয়াল দিতে পারেন না। সে জন্য তাঁদের প্রতীকী চেহারাটি সবার কাছে যেন পরিষ্কারভাবেই পরিচিত। এ প্রসঙ্গে আমার একটি ছোট্ট স্মৃতি মনে পড়ছে। আমি ১৯৮৮ সালে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সূর্য সেন হলের একটি কক্ষে এলাকার পূর্বপরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছে উঠি। তখন আমার সঙ্গে আমাদের এলাকার স্কুলের এক শিক্ষক ছিলেন। সেই সম্মানিত শিক্ষকের স্বভাবজাত পাঞ্জাবি-পাজামা-জুতা ইত্যাদি পোশাক-আশাক দেখে আমার সেই বড় ভাই কৌতূহলের বশেই আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কি না। যখন নিশ্চিত হলো যে তিনি আসলে একজন শিক্ষক, তখন সেই কক্ষের সবারই আচরণ ছিল একটু অন্যরকম শ্রদ্ধাবনত।
অর্থাৎ শিক্ষকদের চিনতেও যেমন কেউ সাধারণত ভুল করে না, ঠিক তেমনি তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মানটুকু দিতেও কেউ ভুল করে না। আর সে জন্যই অনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা লেখক ও শিক্ষক অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ, সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিমনা শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিমের মতো আরো অনেক শিক্ষককে যখন সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, তখন সারা দেশের শিক্ষকসমাজসহ সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। নারায়ণগঞ্জে যখন এক সংসদ সদস্য কর্তৃক স্কুলশিক্ষককে মর্যাদাহানিকরভাবে কানে ধরে ওঠবস করিয়েছে, তখন বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ সকলে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এর ভেতরেও পরিমল বিশ্বাসের মতো শিক্ষকরাও জন্ম নিয়েছে, যারা তাদের কোমলমতি সন্তানসম শিক্ষার্থীদের ওপর মধ্যযুগীয় পাশবিতা চালিয়েছে।
তবে সব কথার বড় কথা হলো শিক্ষকদের মর্যাদা থাকুক সবার ওপরে। কারণ তাঁরাই আমলা, সচিব, এমপি, মন্ত্রীসহ অন্যসব পেশাজীবী তৈরি করেন। কাজেই এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সবার একটিই মাত্র চাওয়া হোক, আর তা হলো শিক্ষকরা থাকুক সবার ওপরে, অন্যথায় জাতি সম্মানিত হবে না। কারণ কাউকে সম্মান করলেই কেবল নিজে সম্মান পাওয়া যায়।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।