বাবা হয়ে আমিও উদ্বিগ্ন
নিস্তব্ধ শহর। মিটমিটিয়ে তারারা জ্বলছে। সবাই ঘুমের ঘোরে। আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছি না। বারবার চেষ্টা করেও না। চিন্তিত মন, উদ্বিগ্ন ভাবনা...। কত সস্তা মানুষের জীবন। কত সহজ এক মানুষের ওপর অন্য মানুষের বর্বরতা চালানো। কত সহজ হত্যাচেষ্টা করা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ব্লগে ভাইরাল হওয়া স্ট্যাটাস বা ছবি কারো অপছন্দ হলেই শুরু হয় অশ্লীল মন্তব্য করা। হুমকি দেওয়া, হত্যা করার হুমকি! এমনকি চাপাতির আঘাতে হত্যার ষড়যন্ত্রও।
কখনো রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যা। কখনো ধর্মের ফতোয়া দিয়ে লেখক-ব্লগার, শিক্ষক, পুরোহিতকে হত্যা। কখনো গাড়ির চালকের অবহেলায় সড়কে হত্যা। কখনো ছেলের দাবি পূরণে ব্যর্থ হলে বাবার গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা। কখনো মা-বাবার পরকীয়ার টানে নিজ সন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা। আবার কখনো তনু-মিতুর জীবন কেড়ে নেওয়া হয়।
রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় ওবায়দুল নামের এক বখাটে। পরে তার উদ্দেশ্য সফল হয়, কারণ ছোট্ট রিশা এই বর্বর সমাজের কিছু বর্বর মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্য জীবনে চলে যায়। বহু স্বপ্ন নিয়ে আসা রিশার মৃত্যু হয়। তার পর আমরা শুনতে পাই, ‘আমি রিশাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম; কিন্তু সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তাই তাকে ছুরিকাঘাত করি।’ এই স্বীকারোক্তি রিশার হত্যাকারী বর্বর ওবায়দুলের জবানবন্দিতে পাওয়া যায়।
এদিকে, সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আড়াইশ টাকা দিয়ে চাপাতি কেনে সেই চাপাতি দিয়েই কলেজ চত্বরে সব বন্ধুর সামনে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে জঙ্গি মনমানসিকতা নিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে বদরুল আলম নামের আরেক বর্বর। এখানেও প্রেম নিবেদনে ব্যর্থ হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে সে খাদিজাকে কুপিয়েছে, এ রকম তথ্য পাওয়া যায়।
একেকটি হত্যার ধরন একেক রকম। ওবায়দুল-বদরুলরা অনায়াসেই তাদের অপরাধ স্বীকার করে। কী কারণে এবং কীভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে, কয়টা কোপ দিয়েছে, কোথায়-কোথায় আঘাত করেছে তা খুব সহজেই বর্ণনা দিয়ে দেয়।
গুলশান হামলায় একে একে ২০টি তাজা প্রাণকে নিষ্প্রাণ করার পরও যখন দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ ও বাঙালি নিয়ে নানান সমালোচনা শুরু, ভিডিও ফুটেজ আর স্থিরচিত্র নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার সাধারণ অ্যাক্টিভিস্টরা যখন সাধারণভাবে নিজেদের চিন্তা-চেতনা আর ভাইরাল হওয়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাহমিদ-হাসনাতকে অপরাধী বা অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়, কিন্তু এরপরও তারা জামিন পায়।
মনের অজান্তেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি আমার সোনামণির কথা চিন্তা করে। এই তো ছোট্ট বয়স চলছে। আর কটা বছর গেলেই রিশার মতন হবে। দৌড়ে কলেজে যাবে খাদিজার মতন। তখন..., তখন তাকেও যদি কেউ প্রেমের প্রস্তাব করে। সেও যদিও রিশা-খাদিজার মতন বখাটে-বর্বরদের প্রত্যাখ্যান করে। তাহলে..., তাহলে আমার মামণিও কি রিশার মতন হত্যা হবে? খাদিজার মতন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমার মেয়েটিও কি ওপারে চলে যাবে আমাকে ছেড়ে?
সমাজ-সংসার যদি সচেতন হয়, রাষ্ট্র যদি কঠোর-কঠিন হয়, তনু-মিতু হত্যাকারীদের যদি সুস্থ বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে আমরা ও আমাদের সোনামণিরাও বখাটে-বর্বরদের হাত থেকে নিরাপদে থাকব।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)