মা দিবস
ইতিহাস বিস্মৃত, বাণিজ্য মুখ্য
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/10/photo-1431253671.jpg)
১৯১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া মা দিবস পেরিয়ে এসেছে ১০০ বছর। আর এই শত বছরে অনেকখানিই বিস্মৃত হয়ে গেছে বিশেষ দিনটির ইতিহাস। অন্য আরো অনেক দিবসের মতো মা দিবসও পরিণত হয়েছে রমরমা বাণিজ্যের উপলক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস ঘিরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেন মার্কিন নাগরিকরা। অথচ যাঁর হাত ধরে এই দিবসের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই আনা জার্ভিস আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন দিনটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে। শেষটায় নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায় মারা গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানসিক হাসপাতালে।
মজার ব্যাপার হলো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার আনা জার্ভিস নিজে কিন্তু নিঃসন্তান ছিলেন। ১৯০৫ সালে তাঁর মা রিভস জার্ভিসের মৃত্যু আনাকে অনুপ্রাণিত করে এই প্রয়াণ দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নিতে। ১৯০৮ সালে তিনি প্রথমবারের মতো আয়োজন করেন মা দিবসের অনুষ্ঠান। সে বছরের ১০ মে তারিখে জার্ভিসের আদিনিবাস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরের পরিবারগুলো একত্রিত হয়েছিল একটি চার্চে। সেই চার্চটি এখন পরিচিত আন্তর্জাতিক মা দিবসের মন্দির হিসেবে। একই সঙ্গে ফিলাডেলফিয়াতেও আয়োজিত হয় পৃথক একটি অনুষ্ঠান।
আনা জার্ভিসের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ক্রমেই অন্যান্য শহর ও প্রদেশেও আয়োজিত হতে থাকে মা দিবসের অনুষ্ঠান। ১৯১৪ সালে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মা দিবস’ বলে ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন। দিনটির তাৎপর্য আনার কাছে কেমন ছিল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার অধ্যাপক ওয়েসলেয়ান আনতোলিনি বলেছেন, ‘জার্ভিসের জন্য এটা ছিল এমন একটা দিন, যখন আপনি বাড়ি গিয়ে মার সঙ্গে সময় কাটাবেন আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন।’
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দিনটি উদযাপনের গতিধারা বদলে যায় জার্ভিসের চোখের সামনে। দিনটি পরিণত হয় রমরমা বাণিজ্যের উপলক্ষে। সবাইকে উৎসাহিত করা হয় ফুল-চকলেট আর নানা রকম উপহার কিনে মাকে উপহার দেওয়ার জন্য। ব্যাপারটি গভীরভাবে আহত করেছিল আনাকে। দিনটিকে তার আদি তাৎপর্য ফিরিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বয়কট করেছিলেন, মামলার হুমকি দিয়েছিলেন। এমনকি একবার আক্রমণ করেছিলেন ফার্স্ট লেডি এলেনর রুজভেল্টকেও। কোনো লাভ হয়নি। ১৯৪৮ সালে ৮৪ বছর বয়সে ফিলাডেলফিয়ার একটি হাসপাতালে নিঃস্ব অবস্থায় মারা যান আনা।
‘মেমোরাইজিং মাদারহুড : আনা জার্ভিস অ্যান্ড দ্য ডিফেন্স অব হার মাদারস ডে’ গ্রন্থের লেখক আনতোলিনি বলেছেন, ‘এই মানুষটা, যিনি স্মৃতিবিভ্রমে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায়; তিনি চাইলে এই মা দিবস থেকে অনেক মুনাফা করতে পারতেন। কিন্তু যারা সেটা করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়েছেন। আর এ জন্য তাঁকে কড়া মাশুল দিতে হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে, শারীরিকভাবেও।’
মা দিবসের মূল প্রোথিত আছে ইতিহাসের আরো গভীরে- আনা জার্ভিসের মা অ্যান রিভস জার্ভিসের সংগ্রামী জীবনের জমিনে। ১৮০০ শতকের মাঝামাঝিতে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার নারী সংগঠক রিভস জার্ভিস, মায়েদের সংগঠিত করেছিলেন নবজাতক মৃত্যুহার, শিশুখাদ্য-দুধের দুষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত চলা মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় এই মায়েরা দুই পক্ষের সৈনিকদেরই সেবাশুশ্রূষা করতেন। যুদ্ধের পর দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধিস্থাপন করে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য জার্ভিস ও তাঁর সহযোদ্ধারা আয়োজন করতেন মাদারস ফ্রেন্ডশিপ ডে পিকনিক। ১৮৭০ সালে ‘মা দিবসের ঘোষণা’ নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশ করেন জুলিয়া ওয়ার্ড হাওয়ে। সেখানে তিনি নারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে নারীদের সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা নেওয়ার জন্য।
কিন্তু ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ায় দিবসটি পরিণত হয়েছে বাণিজ্য করার দিনে। মার্কিনিরা এ বছর দিনটিতে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করবেন বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাইরে খাওয়ার জন্য মা দিবসই বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছুটির দিন। হলমার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, ক্রিসমাসের পর মা দিবসেই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় শুভেচ্ছা কার্ড।