এই পুলিশ কোন পুলিশ? কার পুলিশ?
১৯৫২ সালের পুলিশকে দেখিনি। পড়েছি, জেনেছি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা পথে নেমেছিল। পুলিশের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিল। পুলিশ প্রথমে লাঠিপেটা করেছে। পরে গুলি ছুড়েছে। আহত নিহত হয়েছেন বেশ কজন ভাষা সৈনিক। এই ঘটনা আমাদের মর্মাহত করেছে। কিন্তু আমরা ব্যক্তি পুলিশ বা গোষ্ঠী পুলিশের ওপর তেমন ক্ষুব্ধ হতে পারিনি। কারণ অঘটনটি ঘটেছিল পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের একটি নীতি নির্ধারণী প্রশ্নে। বৈরী পাকিস্তানি শাসকদের কায়েমী স্বার্থের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল ভাষাদ্বন্দ্ব। দৃশ্যত এক দেশ হলেও বৈরি পাকিস্তানি শাসকদের নিবর্তনমূলক নীতির কারণে আমরা হয়েছিলাম নিজভূমে পরবাসী। তাই শাসকদের নির্দেশে পুলিশ পুলিশী আচরণ করেছে। এ কারণে বড় করে পুলিশকে অপরাধী বলতে পারিনি। নির্দেশ দাতা রাষ্ট্রযন্ত্রই হয়েছিল প্রতিপক্ষ। পুরো পাকিস্তানি আমলে অধিকার আদায় ও স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে লড়াই করেছে বাঙালি। বহুবার পুলিশি নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তবু সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছি এই ভেবে যে শত্রুর শাসনে শত্রুতা তো হবেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে একবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনগণের পেছনে লেলিয়ে দিতে দেখেছিলাম সামরিক শাসক এরশাদের সময়ে। ১৯৮৩ সালের কথা। সবে এম এ পরীক্ষা শেষ করেছি। নিজেকে দেশের একজন শিক্ষিত দায়িত্ববান নাগরিক ভাবতে শুরু করেছি। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল। তাই আন্দোলনকারীদের প্রতি দারুণ ক্ষোভ এরশাদের। এক প্রত্যুষে মাইকে ছাত্রদের নিচে নেমে আসার নির্দেশ জারি হয়। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলবেরুনি হলের ছাত্র তখন। তিনতলায় আমার রুমের দক্ষিণের জনালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি যেন যুদ্ধ-প্রস্তুতি। পুরো সাভার সেনানিবাস নেমে এসেছে যেন। পেছনে প্রশস্ত মাঠ। সীমানা ধরে শত শত সৈন্য ঘিরে রেখেছে। মুহূর্তে আমরা নিরীহ ছাত্ররা যেন মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলাম। কোনো রকমে হাত-মুখ ধুয়ে নিচে নেমে এলাম। তাকিয়ে দেখি চত্বরজুড়ে থৈ থৈ করছে পুলিশ, বিডিআর আর মিলিটারি। হলের গেট থেকে নিচে নামতে গিয়ে কড়া ধমক খেলাম একজন সামরিক অফিসারের কাছ থেকে। বাজখাই কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যন্ডস আপ! হাত উপরে তুলে নেমে এসো।’ সেই মুহূর্তে নিজের বুক ক্ষত বিক্ষত হচ্ছিল। একটি স্বাধীন দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়া শেষ করা নাগরিক জানা মতে কোনো পাপ না করে হাত উঁচু করে একজন সেনা অফিসারের আদেশে আত্মসম্মান খুঁইয়ে নিচে নামছে। রাস্তার পাশে লাইন ধরে বসানো হলো আমাদের। তালিকায় যাদের নাম নেই সেই আমাদের বসানো হলো একদিকে। আর নাম থাকাদের অন্য লাইনে। শুধু আমাদের নয় দেখলাম তরুণ শিক্ষকদের কয়েকজনকেও ধরে এনে লাইনে বসানো হয়েছে। শিক্ষক হওয়ার আগে ছাত্র থাকা কালে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তাঁরা। পথের পাশে অসহায়ভাবে লাইন ধরে বসে থাকতে থাকতে একাত্তরের কথা মনে হলো। তখন মনে হয়েছিল এখন তো আর শত্রুর দেশ নয়। স্বাধীন সার্বভৌম আমার নিজের দেশ। তাহলে এই পুলিশ, এই বিডিআর আর এই সেনা সদস্য কারা? নাকি এদের যারা পাঠিয়েছে তারা ছকবন্দি করে পাঠিয়েছে। বিবেক কাজ করছে না। শুধু আদেশমতো মর্মান্তিক অভিনয় করে যাচ্ছে!
তালিকায় নাম থাকাদের সাভার সেনানিবাসে তুলে নেওয়া হলো। পরে জেনেছি কী নিদারুণ নির্যাতন করা হয়েছিল ওদের ওপর। আমরা গোবেচারারা প্রায় সারাদিন পথের পাশে বসে থাকার বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য হলাম। সকাল ১০টার পর ক্যান্টিন থেকে প্রত্যেকের জন্য দুটো রুটি ও ভাজি এলো। পথের পাশে এই অস্থায়ী লঙ্গরখানায় বসে তা খেয়ে পেটকে সান্ত্বনা দিলাম। দুপুরে বিভিন্ন বাহিনীর আস্তানা থেকে যার যার সদস্যদের জন্য মধ্যাহ্নের খাবার এলো। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। বন্দির আবার খাবার কী! বিকেলের দিকে মুক্তি পেলাম। সব বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ল। কিন্তু বিশ্বাস করুন তখনো এসব বাহিনীর সদস্যদের প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয়নি। ঘৃণা তৈরি হয়েছিল এরশাদ সরকারের প্রতি।
এরপরের ইতিহাস ভীষণ গতানুগতিক। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার বাড়তে থাকল। বিএনপি বলি আর আওয়ামী লীগ বলি- এসব দলের রাজনীতি গণতন্ত্র চর্চা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় টিকে থাকার জন্য গণশক্তি নয় পুলিশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই নির্ভরশীলতার জন্যই পুলিশকে নানাভাবে ছাড় দিতে হয় সরকারগুলোকে। অন্যায় দুর্নীতির কুখ্যাতি তো এমনিতেই পুলিশের ছিল এবার তা প্রকাশ্য হতে থাকে। বেপোরোয়া হয়ে পরে। বিভিন্ন পর্বে চট্টগ্রাম, ঢাকা বা অন্য কোথাও দু-চারজন পুলিশ কর্মকর্তা দুর্দমনীয় মাস্তান হিসেবে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক কারণে এই স্খলন ক্রমে বাড়তে থাকে।
শুধু বিরোধী দল নয় সরকারি নীতির সমালোচনা করলে যখন ছোট বড় নেতা মন্ত্রী থেকে শুরু করে খোদ সরকার প্রধানরা পর্যন্ত শিক্ষক, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকেন তখন এসব প্রশ্রয় পাওয়া পুলিশ অনেক বেশি বেপোরোয়া হয়ে পড়েন। আচরণের কারণে এসব পুলিশ আমাদের অচেনা হয়ে যায়। প্রকাশ্যে ঘুষ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকে আর প্রতিবাদীদের ওপর খর্গ হস্ত হয়। রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিরোধী পক্ষকে দমন করার লাইসেন্স পায় বলে এরা আর সাধারণ মানুষের পুলিশ থাকে না। স্বার্থবাদী পক্ষের পুলিশ হিসেবে চড়াও হয় সাধারণের ওপর।
না হলে গত ৯ মে রাতে ঢাকার উত্তরাতে একজন পুলিশ সার্জন গাড়ির কাগজপত্র দেখার নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাকিব আহাম্মদকে বাবা-মায়ের সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার সাহস পান কীভাবে? রাকিবের কোনো অপরাধ যদি পেয়েও থাকে পুলিশ তবুও কোন পুলিশ আইনে আছে এভাবে লাঞ্ছিত করার অধিকার? একইভাবে ১০ মে ছাত্র ইউনিয়ন পয়লা বৈশাখে টিএসসিতে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় মেট্রোপলিটান পুলিশপ্রধানের বক্তব্য শোনার দাবিতে প্রতিবাদী মিছিল ডিএমপি কার্যালয়ের কাছে গিয়েছিল। জনগণের পুলিশ হলে পুলিশ কমিশনার নিজে নেমে এসে প্রতিবাদীদের শান্ত করে ফিরিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা বহিনী থাকতে মর্যাদা খাটো করবেন কেন! ‘জনস্বার্থে’ রাস্তা মুক্ত করতে আন্দোলনকারী ছেলেমেয়েদের নির্মমভাবে লাঠিপেটা করল, জলকামান ছুড়ল, কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হলো। টিভিতে এই নির্মমতা প্রত্যক্ষ করলাম। অসহায়ভাবে দেখলাম তরুণ ছাত্রকে রাস্তায় ফেলে লাঠিপেটা করছে। নারী নির্যাতনের বিচার চাইতে আসা তরুণীকে চুলের মুঠি ধরে লাথি দিতে উদ্যত হচ্ছে পুলিশ।
এই দুই ঘটনার পর একটি সভ্য দেশের স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী, পুলিশের আইজি জাতির কাছে ক্ষমা চাইতেন। এ দেশে নিশ্চয়ই ক্ষেত্র বিশেষে উল্টো নির্যাতন বাড়াবেন। কারণ স্বাধীন দেশ হলেও পুলিশ তো আর জনগণের নয়! শিক্ষক রাকিবের ওপর নির্যাতনকারী পুলিশকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে বা তদন্ত কমিটি গঠন করে আপাতত উত্তেজনার প্রশমন হয়তো সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতি আদর্শের পরিবর্তন না হলে এমন রাহুগ্রাস থেকে আমাদের মুক্তি নাই।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।