সাইবার অপরাধ
নারীদের নিরাপত্তায় নেই কোনো সুষ্ঠু পদক্ষেপ
গত ১২ অক্টোবর ফেসবুকের একটি আলোচিত গ্রুপ DSU (Desperately Seeking Uncensored)। গ্রুপটির তিন এডমিনকে ধরেছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। পরে জানতে পারলাম গ্রুপের বাকি ১৮ জন অ্যাডমিনকে পুলিশ খুঁজছে।
ডিএসইউ গ্রুপটার ভিকটিম আমিও। তবে মজার একটা ব্যাপার এই গ্রুপে প্রচুর রথী-মহারথী, আইনজীবী থেকে সিআইডির অনেক পার্সোনালিটি কিন্তু ছিল। কোনো কারণে তাদের এই গ্রুপের নোংরামি চোখে পড়েনি বা পড়লেও ততটা আমলে নেয়নি। আজ থেকে ছয় মাস আগে বাস থেকে এক মেয়ের বুকের ছবি পোস্ট দিলে এই গ্রুপ থেকে আমি লিভ করি। আমি জানতাম এই গ্রুপ থেকে আমি, আমার মা, আমার বোন, বান্ধবী কেউই নিরাপদ না। এমনকি যে ছেলেরা উল্লাস করছে আরেক নারীর শরীর নিয়ে, তাদের কাছে নারীদের প্রাইভেট ছবি যেকোনো মুহূর্তে লিক হয়ে যেতে পারে। তাই এই গ্রুপ আমার কাছে বিকৃতিদের আখড়াই মনে হচ্ছিল।
মেডিকেল কলেজের দুজন স্টুডেন্টের গোপন ভিডিও ফাঁস করে দেওয়া হয় কোনো এক পর্নোসাইটে। এটা নিয়ে প্রতিবাদ করা জরুরি ছিল। প্রেমিক-প্রেমিকার একান্ত মুহূর্তের ভিডিও ফাঁস করে দেওয়া সাইবার হ্যারাজমেন্ট। অথচ সেদিকে না গিয়ে এই DSU গ্রুপ ভাইরাল করে দিতে থাকল ভিডিও। ভিডিওর নাম দিল ‘৮ মিনিট’। এক লাখ ২২ হাজারের এই গ্রুপ চাইলেই পারত ভিডিওর পেছনের অপরাধীকে খুঁজে বের করতে। তা না করে তা ভাইরাল করে দিল তারা আরো বেশি। এবং মেয়েটা সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছিল জানা যায়। তখনই আমি জানতে পারলাম, এরা ইচ্ছা করেই এই ধরনের ভিডিও ভাইরাল করে। গ্রুপে না থাকার দরুন বন্ধুদের মাধ্যমে স্ক্রিনশট পেলাম, তারা ৬ মিনিট ২২ সেকেন্ডের কোনো ভিডিও ভাইরাল করতে চাচ্ছে।
এসব দেখার পর এবং স্ক্রিনশট জোগাড় করার পর আমি নারীবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল Womenchapter-এ একটি লেখা দিলাম। ‘DSU : অনলাইনে যৌনবিকৃতদের আখড়া’ নামে। এই লেখা খুব সাড়া জাগায়। কিন্তু যেটা হলো DSU-এর গ্রুপ আমাকে নিয়ে পড়ল। সেই কুৎসিত, নোংরা ভাষায় গালিগালাজ, খ ম দিয়ে অভিহিত করা সব চলল। একটু পর আমার আইডি নষ্ট করার ফাঁদ পাতা হলো। Womenchapter website ডাউন করে দেওয়া হলো। কিন্তু Womenchapter-এর এডিটর সুপ্রীতি ধর ও আমি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
জাস্টিস ফর উইমেন পাশে এসে দাঁড়াল। আমাকে নিয়ে এই গ্রুপের নোংরামির প্রমাণ নিয়ে মামলা করতে চলে গেলাম লোকাল থানায়। মামলা নিল না।
মামলার জন্য আমাকে থানার অপারেশন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হলো। তিনি এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিলেন, ‘এসব মামলা থানায় হয় না। BTRC-তে যান।’
BTRC-তে গত এক বছরে যত ফোন দিয়েছি, একজনও ফোন ধরেনি। এই কথা জানানোর পর তিনি শান্ত হলেন। আগেও এই থানা থেকে সাইবার ক্রাইমের ওপর জিডি করেছি বলার পর আরেকটু শান্ত হলেন। তাও মামলা নিলেন না। সাধারণ ডায়েরি করেই আসতে হলো।
এরপরের দিন আবার থানায় গেলাম। প্রথমবার একলা গেলেও এবার সঙ্গে ছিল জাস্টিস ফর উইমেনের মেম্বার মাহবুবুর ভাই। মামলা এবারও নিতে চাইল না। উপরন্তু আমাকে বলা হলো, ‘মামলা করে কোনো লাভ আছে? এসব হইলে ফেসবুক অফ করে দেন।’ আমি তর্ক শুরু করলে তিনি একপর্যায়ে মানেন এবং ওসির সঙ্গে ডাইরেক্ট দেখা করার অনুমতি মেলে।
থানার ওসির কাছে যা জানতে পারলাম, ‘সাতটি মামলা থানায় পড়ে আছে। কোনো অগ্রগতি নেই। BTRC-এর সঙ্গে ফেসবুকের কোলাবরেশন নেই। তাই মামলা নিতে ইচ্ছুক না। যদি সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট অনুমতি দেয় তো মামলা গ্রহণ করা হবে।’
আমরা অনুমতি নিতেই ছুটি ডিএমপির হেডকোয়ার্টারে। সরাসরি কমিশনারের বরাবর আবেদন করা হয়। মাহবুবুর ভাই-ই আমার করা জিডি আর তাঁর সংগৃহীত হাজার হাজার স্ক্রিনশটের প্রমাণ নিয়ে আবেদন করেন। তারপর অবশ্য আমার আর কাজ ছিল না অপেক্ষা করা ছাড়া।
অপেক্ষার ফল মিষ্টি, টের পেলাম ১২ তারিখে। আমার ওপর সাইবার নোংরামির উপযুক্ত শাস্তি দিতে পেরেছি DSU-কে। তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আরো এডমিন খুঁজছে পুলিশ। DSU গ্রুপ বন্ধ শিগগিরই হবে। ভবিষ্যৎ ‘ধর্ষক’ বানানো গ্রুপটির একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আশা করছি। কিন্তু এই গ্রুপে এত যৌনবিকৃতির ইউজার। তাদের মাথা থেকে কি সাইবার নোংরামির বীজ উপড়ানো যাবে সহজে?
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, এই দেশে থানার কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইন সংশ্লিষ্ট লোকজন ফেসবুক বোঝেন না। ফেসবুকে যে কী প্রকারের নোংরামি হতে পারে, সেটা অনেকেরই জানা নেই। এই নতুন দিনের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। একে অস্বীকার করার জো কিছুতেই নেই। তাই এখানে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এখন থেকেই কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশের ডিজিটাল আইন পরিমার্জন করা উচিত। কারণ যত দিন যাচ্ছে, নতুন সমস্যা আসছে। আর তা মোকাবিলা করতে নতুন আইন দরকার। এই দেশের তৃণমূল থানার কর্মকর্তাদের খুব ভালো করে সাইবার ক্রাইমটার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। যাতে ফেসবুকে হয়রানি শুনে তারা কখনোই না বলে, ‘ফেসবুক বন্ধ করে না দিতে’। খুব শিগগির ফেসবুকের সঙ্গে BTRC-এর একটি কোলাবরেশন করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন অবধি নারী সাইবারে নিরাপদ না সে তো বুঝলেনই। কিন্তু নারীও কি প্রতিবাদ করছে? প্রতিবাদ হলে এই বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরে আসবে।
আজ নিজ অভিজ্ঞতা জানানোর একটিই কারণ- বহু মেয়ের নগ্ন ছবি দিয়ে ভুয়া আইডি খুলে মেয়েটির জীবন হতাশায় ভরিয়ে দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে মেয়েটি যাতে চুপ না থেকে লড়াইয়ে নামে। লড়াইয়ের ময়দানে অনেককেই সে পাবে এটা আমি বিশ্বাস করি। আমিও একা ছিলাম। DSU আমাকে যেভাবে লাঞ্ছিত করেছিল, তার ক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে পেরেছি সবখানে। এখানেই আমার লড়াইয়ের সার্থকতা।
লেখক : ফাউন্ডার, ফেমিনিজমবাংলা